মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রত্যাঘাত শুরু

মানবজমিন প্রকাশিত: ০৯ মে ২০১৯, ০০:০০

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সমাগত। নানা অধ্যায়ে বিভক্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপঞ্জি। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে গর্জে উঠেছিল বাংলার কৃষক, শ্রমিকসহ আপামর মুক্তিকামী জনতা। পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউন, গেরিলা যুদ্ধ, ঘটনাবহুল একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই দিনগুলো উঠে এসেছে সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দীদার বখ্‌তের লেখায়।যে সব কাজ কঠিন এবং দুঃসাহসিক তা প্রথম করতে গেলে একটু ভয় ভয় করে। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু একবার সাহস করে এগিয়ে গেলে ভয় দূর হয়ে যায়। সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করলেই সেই দুঃসাহসিক কাজটি জয়লাভ করা সম্ভব। যত শক্ত ও কঠিন হোক না কেন সাহসী মনোবল নিয়ে সেই কাজ অবশ্যই করা সম্ভব। সেটাই করে দেখালো আমাদের অকুতোভয় সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছেলেরা।প্রথম যুদ্ধে জয়লাভ করার পর তাদের সাহস গেল বেড়ে এবং যেকোনো শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলো। আমাদের সব থেকে বড় সমস্যা হলো অস্ত্রের স্বল্পতা। কীভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করা যায় সেই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কামেল প্রস্তাব দিলো রাস্তায় যে সব পুলিশ অস্ত্র নিয়ে পাহারা দেয় তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে আমাদের ছেলেদের দেয়া যায়। আমি তাকে বললাম যদি ওরা কোনো রকমে টের পায় তবে সমূহ বিপদ হবে- সেদিকে খেয়াল রাখবে। প্রথমে বাধা দিলেও কামেলের পরিকল্পনা শুনে মনে হলো এটা সম্ভব।সেই মতো কামেল শুধুমাত্র একজন সহযোদ্ধা নূরুলকে নিয়ে পাটকেলঘাটা ব্রিজে পাহারারত সেপাইদের অস্ত্র কেড়ে নিতে গেল। কপোতাক্ষ নদের উপর কুমিরা ও পাটকেলঘাটাকে সংযুক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে এই ব্রিজটি। ব্রিজটির দুই দিকে মিলিটারিরা খনন করে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল। ওদের ভয় ছিল মুক্তিবাহিনী গাড়িবহর নিয়ে ব্রিজ পার হয়ে আক্রমণ রচনা করতে পারে। ব্রিজের দু’পাশ কেটে গাড়ি চলাচল বন্ধ করে রেখেছিল। দু’পাশে ২জন ২জন করে পাহারা রেখেছিল। লোক চলাচল করলে তাদের সার্চ করে তবে ব্রিজ পার হতে দেয়া হতো।কামেল তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে সাধারণ গ্রাম্য লোক হিসেবে ব্রিজ পার হওয়ার জন্য গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। সাধারণ মানুষ হিসেবে তারা পুলিশের কাছে এগিয়ে যায় এবং আচম্বিতে তাদের দিকে পিস্তল তাক করে রাইফেল কেড়ে নেয়। এরপর তাদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে ব্রিজের অপর পাড়ে পাহারারত দুজন পুলিশের কাছে যায় এবং তাদের রাইফেল দুটি কেড়ে নেয়।এরপর মুক্তিবাহিনীর ৪/৫ জন যারা একটু দূরে অবস্থান করছিল তাদের ডেকে নিয়ে পাটকেলঘাটা ডাকবাংলোতে ১০/১২ জন পুলিশ অবস্থান করছিল তাদের অতর্কিত ভাবে আক্রমণ করে। অসতর্ক পুলিশ দল অসহায় ভাবে তাদের সকল অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমর্পণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।পুলিশদের বলা হলো তোমরা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছো। তোমাদের মেরে ফেলা উচিত। কিন্তু না আমরা হত্যাকারী নই। তোমাদের ছেড়ে দিচ্ছি। তোমরা বাঙালি তাই। আমাদের মুক্তি বাহিনীতে যোগদানের সুযোগ দিচ্ছি। তোমরা এই রাত্রেই ভারতে চলে যাও মুক্তিবাহিনীতে যোগ দাও। অথবা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করো। পুলিশের সকলেই কান্নাকাটি শুরু করে বললো- তাদের ছেলেমেয়েরা আছে আর্মি তাদের মেরে ফেলবে। তাদের মিনতি তাদের একটা সুযোগ দেয়া হোক। তারা অবশ্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবে বলে আমাদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিলো। এভাবেই অস্ত্র সংগ্রহ করে শক্তি বৃদ্ধি করা শুরু করলাম আমরা। ইতিমধ্যে পাকিস্তানি সরকার প্রতিটি ইউনিয়নে ইউনিয়নে চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে শান্তি কমিটি করা শুরু করেছে। অধিকাংশ চেয়ারম্যান মুসলিম লীগের হওয়ায় তারা তাদের চেলা-চামুণ্ডাদের নিয়ে শান্তি কমিটি তৈরি করে ফরমান জারি করলো যে, মুক্তিবাহিনীর কোনো লোক দেখলে তারা যেন থানায় সংবাদ দেয়। অথবা ধরে এনে শান্তি কমিটির কাছে সোপর্দ করে। এভাবেই শান্তি কমিটির দৌরাত্ম্য বেড়ে চললো। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের বাড়ি থেকে তুলে এনে নির্যাতন শুরু করলো অথবা রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে অত্যাচার করতে লাগল। রাজাকাররা নির্যাতন চালিয়ে তাদের নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলতে লাগল। অত্যাচারী শান্তি কমিটির নির্যাতনের খবর বিপ্লবী সরকারের কাছে গেলে তারা উপযুক্ত শাস্তির জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশ দিলেন।ইতিমধ্যে তালাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অসামান্য সফলতার বর্ণনা দিয়ে আকাশবাণী থেকে দেব দুলাল বন্দোপ্যাধ্যায় খবর প্রচার করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে মুকুল ভাই “চরমপত্রে” মুক্তিবাহিনীর ‘ক্যাচকি’ মারের অসাধারণ বর্ণনা প্রচার করেছিলেন। সেখানে কামেলের দুর্দান্ত সাহসিকতার বর্ণনাও প্রচার করেছিলেন এম.আর আক্তার মুকুল ভাই।মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ, থাকা ও খাওয়া, চলাচল এবং অন্যান্য সরঞ্জামের সমস্যা দেখা দিলো। গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রামের লোকেরা ব্যবস্থা করলো। যার যেমন সামর্থ্য তেমনভাবে তারা চাল-ডাল দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করলো।মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় প্রতিদিন নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসতাম। রাজাকার ও শান্তি কমিটির কার্যকলাপ এবং তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানার জন্য কিছু কিছু পদক্ষেপ নেয়া হলো। তালা বাজারে প্রাণকৃষ্ণের একটা চায়ের দোকান ছিল। চায়ের দোকানে যে সব আলাপ-আলোচনা হতো তা প্রাণকৃষ্ণ রাতে আমাদের জানাতো। রাজাকার বাহিনীর গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য দশম শ্রেণির ছাত্র মীর আবুল কালাম আজাদকে কাজে লাগানো হলো।    কালামের বাবার একটি সাইকেলের দোকান ছিল। তার সুবিধা ছিল সাইকেল ব্যবহার করার। ছোট ছেলে তাকে কেউ সন্দেহ করবে না। তার অবাধ বিচরণ ছিল সব জায়গায় তাই তাকে সংবাদ সরবরাহের কাজে নিযুক্ত করা হলো। তাদের মাধ্যমে নিয়মিত সংবাদ পেতে লাগলাম আমরা।    তালা বাজারের প্রভাবশালী একজন সদস্য যার ভাই আর্মিতে কাজ করেন। তিনি শান্তি কমিটির সেক্রেটারি। তিনি তালাতে আর্মি ঘাঁটি সৃষ্টি করার জন্য যশোর ক্যান্টনমেন্টে প্রায়ই যাতায়াত করতেন। ইতিমধ্যে বিপ্লবী সরকারের কাছ থেকে শান্তি কমিটির প্রতিক্রিয়াশীল দালাল সদস্যদের শাস্তি দেয়ার নির্দেশ এসেছে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে।    তালাতে মুক্তিযোদ্ধারা একটি টিম গঠন করে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করলো। তাদের শাস্তি কার্যকর করার সঙ্গে সঙ্গে শান্তি কমিটির সদস্যদের মাঝে ভয় ছড়িয়ে পড়লো। তারা আর আগের মতো নিঃশঙ্কচিত্তে সরকারের ছত্রছায়ায় মুক্তিবাহিনীর সহযোগীদের/সহায়তাকারীদের বিরুদ্ধে কাজ করার সাহস হারিয়ে ফেললো। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কার্যক্রম জোরদার ভাবে চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলো। এভাবেই গ্রাম অঞ্চলের মানুষ পাকহানাদার বাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অপেক্ষায় দিনাতিপাত করতে লাগল। মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি অপারেশন ফলাও করে মুকুল ভাই “চরমপত্রে” স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করছিলেন। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে যুদ্ধের ভয়ভীতি ক্রমে ক্রমে হ্রাস পেতে লাগলো এবং সাধারণ মানুষ সকল ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়াতে লাগলো। তার প্রমাণ মিললো তালাতে সংগঠিত পরপর কয়েকটি যুদ্ধের ঘটনার মধ্য দিয়ে। (চলবে)

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও