কুইক লিঙ্ক : মুজিব বর্ষ | করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব | প্রিয় স্টোর

যুদ্ধজয়, উদ্দীপ্ত মুক্তিযোদ্ধার

মানবজমিন প্রকাশিত: ০৫ মে ২০১৯, ০০:০০

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সমাগত। নানা অধ্যায়ে বিভক্ত মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপঞ্জি। মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে গর্জে উঠেছিল বাংলার কৃষক, শ্রমিকসহ আপামর মুক্তিকামী জনতা। পঁচিশে মার্চের ক্র্যাকডাউন, গেরিলা যুদ্ধ, ঘটনাবহুল একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধকালীন সেই দিনগুলো উঠে এসেছে সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ দীদার বখ্‌তের লেখায়।চুকনগর গণহত্যা প্রত্যক্ষ করার পর এলাকার জনগণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি ঘৃণায় প্রতিরোধ সৃষ্টির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে শুরু করলো। সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনীর দোসর রাজাকার বাহিনী এবং তাদের মদতকারী শান্তি কমিটির প্রতি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো।রাজাকার বাহিনীর একমাত্র কাজ ছিল এলাকার বর্ধিষ্ণু লোকের বাড়ি লুট করা এবং মেয়েদের নির্যাতন করা। শান্তি কমিটির কাজ ছিল গ্রামের মধ্যে যুবকদের ডেকে নিয়ে হুমকি দিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের পক্ষে নেয়ার চেষ্টা করা। বয়স্ক ও যুবকরা যারা তাদের পক্ষে কাজ করবে না তাদের সম্পর্কে সেনাক্যাম্পে রিপোর্ট করা অথবা রাজাকারদের ডেকে এনে তাদের ধরে নিয়ে রাজাকার ক্যাম্পে নির্যাতন করা কিংবা মেরে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া। এর ফলে গ্রামের যুবকরা দিশাহারা হয়ে ঘরবাড়ি ত্যাগ করে নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। গ্রামে কোনো অপরিচিত লোক দেখলেই রাজাকার বাহিনীর লোক তাদের ধরে নিয়ে ক্যাম্পে নির্যাতন করতো। ফলে সমগ্র দেশ এক বিভীষিকায় ও আতঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে পড়লো। এ অবস্থায় যুবকরা দেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়া শুরু করলো। হয় বেঁচে থাকবো নাহলে প্রতিরোধ যুদ্ধে জীবন দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হটাতে চেষ্টা করবো। এই মানসিকতায় যুব সমাজ দেশের অভ্যন্তরেই নিজেদের সংগঠিত করতে শুরু করলো। রাজাকার বাহিনী ধীরে ধীরে প্রতিটি থানাতে তাদের ঘাঁটি করতে শুরু করেছে। আমরা ঠিক করলাম তালা থানাতে রাজাকারদের ঘাঁটি গাড়তে দেয়া হবে না। আমরা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে লাগলাম। গ্রামের অভ্যন্তরে ট্রেনিং দিয়ে মুক্তিবাহিনীর মনোবলকে জোরদার করার কাজে নিয়োজিত করলাম। যেকোনো মূল্যে রাজাকার বাহিনীকে প্রতিহত করা হবে।পাশের থানা পাইকগাছা। সেখানে রাজাকাররা শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। খবর পাচ্ছি তারা প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে বাড়িঘর লুট করছে। যারা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরোধিতা করছে তাদের ধরে এনে কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দিচ্ছে। কপোতাক্ষ নদ তখন লাশের মিছিলে ছেয়ে গেছে। গলিত লাশ জোয়ার- ভাটায় নদীপাড়ের মানুষ প্রত্যক্ষ করছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য। পাইকগাছা থানার রাজাকারদের শক্ত ঘাঁটি কপিলমুনি। কপিলমুনি বাংলাদেশের দক্ষিণ- পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে অন্যতম বর্ধিষ্ণু ও প্রসিদ্ধ বাণিজ্যিক স্থান।খবর পেলাম এই কপিলমুনি থেকে একটি রাজাকার দল তালা থানায় তাদের ঘাঁটি তৈরি করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা ঠিক করলাম তালাতে রাজাকার ঘাঁটি করতে দেয়া হবে না।    তালা সদর ইউনিয়নের কতিপয় শান্তি কমিটির নেতা কপিলমুনিতে রাজাকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিয়ে আসছে। কপিলমুনিতে কামেল বখ্‌তের বন্ধু নেছার শেখ পোস্ট অফিসে কর্মরত। তার মাধ্যমে টেলিফোনে যোগাযোগ করে রাজাকারদের গতিবিধি জানতে থাকি।ঠিক হলো রাজাকাররা কপিলমুনি থেকে রওয়ানা দিলেই নেছার তালা পোস্ট অফিস থেকে আমাদের জানিয়ে দেবে। সেই মতো আমরা তাদের প্রতিরোধ করতে পারবো।তারিখ ঠিক মনে নেই। নেছার খবর দিলো কপিলমুনি থেকে রাজাকারের একটি দল তালা যাচ্ছে।    খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর একটি দল তালা থানাকে বাইপাস করে মোবারকপুর নদীর পাড়ে অবস্থান নেই। অপেক্ষা করতে থাকি রাজাকারদের নৌবহরের। প্রায় আধাঘণ্টা অপেক্ষা করার পর রাজাকারদের নৌবহর দেখা গেল। তারা আমাদের সামনে আসা মাত্র আমরা গুলিবর্ষণ শুরু করলাম। রাজাকাররা ভয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়া শুরু করলো। ওদের কমান্ডার ছিল খালেক। সে নদীতে ঝাঁপ দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করা হলো। রাজাকারদের ২০/২৫ জন নদীর মধ্যেই সমাহিত হলো। বীরদর্পে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা অক্ষত অবস্থায় তেতুলিয়া ঘাঁটিতে ফিরে আসলো। ওই দিন যুদ্ধে আমাদের দুটি অবস্থান ছিল। একটি আক্রমণ অবস্থান দ্বিতীয়টি আধা কি.মি. দূরে ১০/১৫ জন মুক্তিযোদ্ধার ব্যাকআপ অবস্থান।    প্রথম আক্রমণ অবস্থান, যদি কোনো কারণে পিছু হটতে বাধ্য হয় তবে আধা কি.মি. আসলেই দ্বিতীয় দল তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। এটাই ছিল যুদ্ধের কৌশল।    প্রথম আক্রমণেই জয়ী হয়ে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা বীরদর্পে যখন তেতুলিয়ায় আমাদের বাড়িতে আসলো, তখন আমার মা ছেলেদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) ফুলেল অভ্যর্থনা জানালেন। তাদের আদর করে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে বললেন। “সোনার ছেলেরা তোমরা যুদ্ধ জয় করে ফিরে এসেছো- তোমরা দেশের গৌরব, দেশ তোমাদের মনে রাখবে- শ্রদ্ধা করবে।” মা’র সেই উক্তি এখনো আমার মনে জাগ্রত। মা বিজয়ী ছেলেদের খাবার ব্যবস্থা করছিলেন। ওদের পুকুর থেকে গোসল করে আসতে বললেন।    রাস্তায় দুজন গার্ড রেখে ছেলেরা যখন গোসল করছে সেই সময় একটি গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল। সন্দেহ হলো হয়তো সেনাবাহিনীর গাড়ি। এর পরপরই গুলির আওয়াজ এবং টায়ার ফাটার বিকট আওয়াজ। গোসল বাদ দিয়ে তখন ছেলেরা যে যার রাইফেল হাতে তুলে নিয়ে ছুটলো অবস্থান নেয়ার জন্য।    আমাদের তেঁতুলিয়া বাড়ি থেকে ৪০/৪৫ গজ দূরে রাস্তায় তখন একটি বাস থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ করে চলছে।  গুলিবৃষ্টির মধ্যে আমাদের ছেলেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লো।    বাসে করে সাতক্ষীরা মহকুমা সদর থেকে একটি পুলিশ বাহিনী তালার যুদ্ধ সম্পর্কে সংবাদ পেয়ে মুক্তিবাহিনীকে হটাবার জন্য আসছিল। পথিমধ্যে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয় তারা। পুলিশ বাহিনী বাস থেকে নেমে রাস্তার দু’পাশের গর্তে পজিশন নিয়ে অনর্গল গুলি করে চলছে। এই অবস্থার জন্য মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা প্রস্তুত ছিল না। প্রথমে কিছুটা পিছু হটে গেলেও আবার তারা সংগঠিত হয়ে প্রতি আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হলো। তেঁতুলিয়া গ্রাম তখন প্রকৃত অর্থে যুদ্ধক্ষেত্র। এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক কামেল দুজনকে সঙ্গে নিয়ে  একটু ঘুরে রাস্তার পূর্ব পাশ থেকে আক্রমণ রচনা করলো। প্রথম গুলি করে পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বললো- তোমরা চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে গেছো। সারেন্ডার কর, নইলে মৃত্যু অনিবার্য।    আমি তখন আমার ৭/৮ বছরের ভাইপো জুলফিকার আকবরকে নিয়ে বাড়ির অদূরেই পাজাখোলায় গেছি। সে সময় কামেলের তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর কানে এল। আমি জুলুকে পাজাখোলার মধ্যে রেখে বাইরে বেরুতে বারণ করে বড়ভাই  কোহিনূর ভাইয়ের বাড়ির ভেতর দিয়ে রাস্তার পশ্চিম পাশে এসে অবস্থান নেয়ার জন্য ছুটে যাই। কোহিনূর ভাই ছিলেন অসুস্থ। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন ওখানে যাস না ওরা মেরে ফেলবে। আমি বললাম আমি কামেলের আওয়াজ শুনেছি। ও আক্রমণ করেছে। আমাকে যেতে হবে ওকে সাহায্য করার জন্য। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি রাস্তার অপর পাশ থেকে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে ওদের আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানালাম।    এরপর পুলিশ বাহিনীর পেছন থেকে  মারুফ হোসেন তুরান ও নুরুল ইসলাম এদের কণ্ঠস্বর শুনলাম। ওরাও গুলি ছুড়ে, যুদ্ধাবস্থায় পুলিশকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান করছে। পুলিশ বাহিনী অবিরাম গুলিবর্ষণ করেই চলছে। যখন তিনদিক থেকে তাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য নির্দেশ আসছে। উপায়ান্তর না দেখে তারা চিৎকার করে গুলি থামাতে বললো- এবং আত্মসমর্পণ করার ঘোষণা দিলো।     তখন তাদের মাথার উপর  হাত তুলে লাইন করে সামনে গিয়ে আমাদের মুক্তি বাহিনীর কাছে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দেয়া হলো। পুলিশ বাহিনীর প্রায় ৩৫/৩৬ জন এভাবেই মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের কাছে আত্মসমর্পণ করলো।পুলিশ বাহিনীকে পরিচালনা করছিলেন সাতক্ষীরা জেলার এসডিপিও (সাব ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার)। তাদের সকল অস্ত্র এবং গোলাগুলি আমরা দখল করলাম। ওদের কর্ডন করে আমাদের বাড়ির পুকুরঘাটে বসিয়ে রাখলাম। বড়ভাই কোহিনূর আকবর অসুস্থ অবস্থায় এসে হাজির হলেন। কামেল ওদেরকে বেঁধে ভারতে পাঠাবার জন্য আমার পরামর্শ চাইলো। এসডিপিও সাহেব আমাকে ও  কোহিনূর ভাইকে অনুরোধ করলো তাদের ছেড়ে দেয়ার জন্য। এক পর্যায়ে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা হাউমাউ করে কান্নাকাটি শুরু করলো। বললো আমাদের ঘর-সংসার, ছেলেমেয়েরা আছে। সেনাবাহিনী ওদের মেরে ফেলবে। এসডিপিও সাহেব  কোহিনূর ভাই মুরুব্বি হিসেবে তার কাছে আবেদন করলো। তার আবেদন বিবেচনায় নিয়ে একটি চুক্তি হলো। চুক্তি অনুযায়ী  সাতক্ষীরা পুলিশ বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবাধে চলাফেরায় কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না। বরং তারা আগাম খবর পেলে মুক্তিবাহিনীর যাতায়াতে সাহায্য করবে। এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে সেদিন আমরা  কোহিনূর ভাইয়ের অনুরোধে পুলিশ দলকে ছেড়ে দিয়েছিলাম কিছু গুলি রেখে দিয়ে। এসডিপিও সাহেব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন অস্ত্র ও গুলি লাগলে সরবরাহ করবেন। এভাবেই সেদিন সাতক্ষীরা অঞ্চল মুক্তিবাহিনীর অবাধ চলাচলের রুট হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল।    এই যুদ্ধের পর আমরা আন্দাজ করেছিলাম, সংবাদ পেয়েই পাকবাহিনী আমাদের বিতাড়িত করতে প্রস্তুত হয়ে আসবে। শক্তিশালী পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে শক্তিমত্তায় পেরে উঠবো না জেনেই আমরা আমাদের অবস্থান রাতারাতি পরিবর্তন করলাম। গ্রামের যুবতী মেয়েদের নিকটবর্তী নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার ব্যবস্থা করলাম। মাকে পাশের বাড়ি সামছুদ্দিনের বাড়িতে রেখে আসলাম।    আমাদের অনুমান সঠিক প্রমাণিত হলো। পরদিনই  যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে মিলিটারি গাড়িবহর আমাদের গ্রামে হানা দিলো। কাউকে না পেয়ে তারা আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো। আগুন জ্বলতে থাকা অবস্থায় পাকবাহিনী স্থান ত্যাগ করলে গ্রামের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা গ্রামবাসী দলে দলে এসে আগুন নেভালো। গ্রামের সাধারণ মানুষ যে আমাদের সর্বাত্মক সমর্থন করছে এই দ্রুত আগুন নেভানোতে তা প্রমাণিত হলো। যে বাড়িতে আমার মা অবস্থান করেছিলেন  সেখানে পাকবাহিনী জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। মা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধুমাত্র হাতের তসবি দেখিয়ে বলেছিলেন- এটাই তার বাড়ি। এভাবেই একই দিনে দুটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী জয়ী হওয়ায়  নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে লিপ্ত হলো। -চলবে

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও