![](https://media.priyo.com/img/500x/https://amadershomoy.com/sites/default/files/styles/lead/public/2019-01/Untitled-22%20copy.jpg?h=cd391a4a&itok=PXKpuaW5)
সুন্নতের অপমান, সুযোগ বুঝে পিঠটান!
১৯৭৩ সাল। আমি তখন টগবগে যুবক। চুলদাড়ি উঠেছে। কিন্তু এখনকার মতো এতো বাউলীয়ানা স্টাইলের নয়। ফ্রান্সকাট। আবার সুন্নতি দাড়িমোচও বলা যায়। এখন যেমন অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলিম কখনো-সখনো আমাকে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার পর জিজ্ঞেস করে, “আপনার মোচ তো সুন্নতি মোচ নয়। আপনি পানি খান ক্যামনে?” তখন ধুনফুন বলে বুঝিয়ে দিই। কিন্তু যুবক বয়সে তো তা ছিলো না। মোচদাড়িÑউভয়ই ছাঁটা। ঠোঁট বের করা। দাড়িটাও হুজুর-স্টাইলে কাটা। ফলে আমার কোনো অসুবিধা হয় না! অনেক সময় যেমন সালাম পাই, তেমনি সমাদরও কম নয়। বিশেষত রিকশাওয়ালারা পরহেজগার মানুষ ভেবে অনেক সময়ই রিকশা থেকে নেমে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করে। আমি হাত তুলে চোখ বুজে দোয়া করি। সবে চাকরি পেয়েছি দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায়। ফিচার রাইটার হিশেবে। কিছুদিন আগেই কবি নির্মলেন্দু গুণ গণকণ্ঠ অফিস থেকে কাজ ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি যখন কাজ করতেন, তখন এর অফিস ছিলো উয়ারী র্যাংকিন স্ট্রিটে। আর আমি যখন যোগ দিতে যাই, তখন ওয়ারীরই টিপু সুলতান রোডে। থাকি ফকিরাপুল এজিবি কলোনির একটি ফ্লাটের তিনতলায়। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ালেই ফকিরাপুল চার রাস্তার মোড়। কমলাপুর থেকে সব বাস এদিক দিয়ে এসে মোড়ে থামে। আমি সেখান থেকে বাসে উঠে মতিঝিল-গোপীবাগ হয়ে দৈনিক ইত্তেফাকের মোড়ে গিয়ে নামি। কম টাকা বেতন পাই। তাই রিকশায় যেতে পারি না। বাসেই যেতে হয়। ইত্তেফাকের মোড়ে নেমে হেঁটে হেঁটে উয়ারী হয়ে বলধা গার্ডেন পার হয়ে গণকণ্ঠ অফিসে যাই। আমি তখন বেকার। জাসদের আফতাব আহমদ দলের একজন বড় সংগঠক ছিলেন। তিনি আমার ছোট বোনের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ব্যাচে পড়তেন। সেইসূত্রে এবং কবি হিশেবে আমাকে তিনি চিনতেন। আমি যখন জগন্নাথ হল থেকে যাবো যাবো করছি, তখন একদিন তিনি হল ক্যাফেটরিয়ায় আসেন। আমার সঙ্গে পরিচয় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর শেষ করে আমি বেকার বসে আছি। চাকরি খুব দরকার। আফতাব গণকণ্ঠের একজন কেউকেটা, আমার জানা ছিলো না। আমার কথা শুনে বললেন, “দাদা আমাদের পত্রিকায় আসেন না। আমরা আপনার সহযোগিতা চাই।” পরের দিন অফিসে গেলে আমাকে ফিচার রাইটার পদের অফার দেয়া হয়। আমি রাজি হয়ে যাই। তখন গণকণ্ঠের সম্পাদক কবি আল মাহমুদ। মাহমুদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬৯ সাল থেকে। তিনিও আমাকে পেয়ে খুশি হন। যাই হোক, পরের দিন থেকে নিয়মিত অফিসে যাতায়াত শুরু করি। তো, সেদিনও বাসে উঠে অফিসের দিকে যাচ্ছিলাম। ভিড়ের মধ্যে কারো একজনের পায়ে পাড়া লেগে গেলে তিনি চিৎকার দিয়ে আমাকে ধমকাতে শুরু করেন। আমি বিব্রত। আমি তো ইচ্ছে করে তার পায়ে পাড়া দিইনি। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। আমাকে আজে-বাজে কথা বলতেই লাগলেন। আমারও ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। আমিও তর্ক শুরু করলাম। হঠাৎ তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, “ধ্যাৎ মিয়া, দাড়ি রাইখ্যা আবার ঝগড়া করতেছেন?” এতোক্ষণ ধরে যারা বাসের ভেতর আমাদের তামাশা দেখছিলেন, তারা অনেকে থামানোর চেষ্টা করছিলেন। তর্ক করতে করতে বাস চলে এলো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে। সেখানে একটি স্টপেজ আছে। দাড়ি নিয়ে কথা বলাতে আমি লোকটার ওপর ক্ষেপে গিয়ে বললাম, “এই মিয়া, পায়ে পাড়া লাগছে বলে কি আপনি সুন্নতের ওপর কথা বলবেন?” আর যায় কোথায়? বাসের সকল মুরুব্বি মুহূর্তে আমার পক্ষে চলে এলেন। তারা সকলেই লোকটার ওপর হামলে পড়লেন। বললেন, “ঠিকই তো, মিয়া আপনে ক্যান সুন্নত নিয়া কথা কইলেন?” আমি দেখলাম, অবস্থা বেগতিক। এখন পিঠটান দেয়া ছাড়া উপায় নেই! আসল পরিচয় জানলে আমার কপালে দুঃখ আছে। আমি দেরি না করে বাংলাদেশ ব্যাংক স্টপেজে নেমে গেলাম। বাসের ভেতরের লোকগুলো তখনও সুন্নতের ব্যাপার নিয়ে পরস্পর ঝগড়া করেই চলেছে! লেখক : কবি ও সংযুক্ত সম্পাদক, দৈনিক আমাদের নতুন সময়
- ট্যাগ:
- মতামত
- জীবন
- জীবন বিধান