শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনের পথে প্রতিবন্ধকতা চাই না
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন যে জায়গায় অবস্থান করছে, তা নিশ্চিতভাবেই উদ্বেগের কারণ। এটা বাংলাদেশের জন্য যেমন উদ্বেগের কারণ, ভারতের জন্যও একইরকম ভাবে এটা উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত। তিনভাবে আমি একে দেখি। আগস্টে বাংলাদেশে যে ব্যাপক রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক-সবকিছুতেই একটা বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে দিল্লির সঙ্গে ঢাকার পূর্ববর্তী সরকারের যে সম্পর্ক ছিল তা যে বাংলাদেশের জনগণ পছন্দ করেনি, তার একটা স্পষ্ট প্রতিফলন আমরা গত বছরের আগস্টে দেখতে পেয়েছি। দ্বিতীয় নমুনাটা সাম্প্রতিককালে দেখেছি। তা হচ্ছে ওসমান হাদি। তিনি ছিলেন তরুণ বাংলাদেশের উদীয়মান একজন স্পষ্টভাষী নেতা। তিনি চলতি মাসের ১২ তারিখে গুলিতে আহত হওয়ার পর এবং এর এক সপ্তাহ পরে তার মর্মান্তিক দুঃখজনক মৃত্যুর পরে যেভাবে তার জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিল, তাও জানান দিচ্ছে যে, তিনি যে আধিপত্যবাদবিরোধী বক্তব্য দিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে মানুষের মনের কাছে পৌঁছেছিলেন। তার মৃত্যুর পর জানাজায় মানুষের ব্যাপক উপস্থিতির মধ্য দিয়ে, তাকে সম্মান জানানোর মধ্য দিয়ে তার জবাব তারা দিয়েছেন।
এ ঘটনাগুলো সাদা চোখে দেখলে মনে হয় যে, এগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ ঘটনা। কিন্তু এগুলো অভ্যন্তরীণ ঘটনা নয়, এ ঘটনাগুলো আমাদের দেশের বাইরেও একটা প্রতিফলন আছে। এক্ষেত্রে বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কটা পুনর্বিন্যস্ত হওয়া দরকার। প্রতিবেশীর সঙ্গে আমাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা আছে। তবে তা সম্মানজনক এবং সমতার ভিত্তিতে হওয়া প্রয়োজন। সে বিষয়টি অন্তত এ দুটি ঘটনার মধ্য দিয়ে মানুষের চোখের সামনে ব্যাপকভাবে উঠে এসেছে। এ প্রেক্ষাপট থেকেই আমার ধারণা, গত এক সপ্তাহ বা কয়েক দিন আগে থেকে আমরা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মধ্যে যে উত্তেজনা দেখছি, তার সূত্রটা এখানে। এবং আমরা লক্ষ্য করলাম, এখানে একটা অভিযোগ করা হয়েছে, ওসমান হাদির হত্যাকারী ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের দিক থেকে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করা না হলেও বিভিন্ন সূত্র থেকে যে তথ্যগুলো পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বলা হচ্ছে, হাদির হত্যাকারীরা ভারতে পালিয়ে গেছে।
এখন কথা হলো, এ ব্যাপারে ভারতের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কিনা আমি জানি না। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে গেছে, সেভাবে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ভারতে অবস্থানকারী লোকজনের (বিগত সরকারের) একটা যোগাযোগ রয়েছে, এমনটা জনমনে অন্তত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সে জায়গায় আমার ধারণা যে, ভারত যদি এ ক্ষেত্রে একটু সংবেদনশীল হয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করার কথাটা বলত, অর্থাৎ ‘ঠিক আছে, এরকম ঘটনা ঘটে থাকলে আমরা নিজেরাও খুঁজে দেখছি। তোমাদের কাছে তথ্য থাকলে আমাদের জানাও। যদি অপরাধী এখানে এসে থাকে, আমরা তাকে ধরার চেষ্টা করব এবং তাকে আইনের আশ্রয়ে নেওয়ার জন্য আমরা সহযোগিতা করব,’ তবে কিন্তু পরিস্থিতি অন্য রকম হতে পারত। কিন্তু আমরা সেরকম কোনো বক্তব্য দেখিনি এবং সেই সংবেদনশীলতার অভাবের আলোকেই আমরা বরং দেখলাম, এখানে দিপু দাস বলে এক হিন্দু শ্রমিক, তার ওপর আক্রমণ হলো, তাকে হত্যা করা হলো এবং এই ‘মব’ যেটাকে বলে, সেই ঘটনা ঘটল। এর পাশাপাশি আমরা প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানটসহ অনেক জায়গায় আক্রমণ লক্ষ করলাম। ভারতের প্রতি জনগণের ক্ষোভের এই যে বহিঃপ্রকাশ, এটা কিছু অংশে সিস্টেম্যাটিক। তবে দিপু দাসের ক্ষেত্রে এটাকে সিস্টেম্যাটিক বলা যাবে না। তবে ‘মব ভায়োলেন্স’ বলে যে একটা ফেনোমেনন তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে, তার একটা নিকৃষ্ট উদাহরণ এ ঘটনাগুলো থেকে আমরা পেয়েছি।
কিন্তু বাংলাদেশের কোনো মানুষ এগুলোকে সমর্থন করছে না, মানে চিন্তাশীল মানুষ যারা রয়েছেন, তারা কিন্তু এটা সমর্থন করছে না এবং সরকারের দিক থেকেও সমর্থন করা হচ্ছে না। অনেকে বলেন যে, সরকার এ ব্যাপারে দুর্বলতা দেখাচ্ছে, তারা আগেভাগেই এগুলো প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে পারছে না। কিন্তু এটাও ঠিক যে, সরকার এসব অপরাধে যারা জড়িত ছিল, তাদের ধরার জন্য সচেষ্ট আছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে ধরেওছে। সেই জায়গায় বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বা বাস্তবতার আলোকে না দেখে বরং ঢালাওভাবে যেভাবে ‘বাংলাদেশ জঙ্গিবাদী হয়ে যাচ্ছে’, ‘এখানে ইসলামিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হচ্ছে’ ইত্যাদি বক্তব্যগুলো ভারতের দিক থেকে তৈরি হয়েছে। সে প্রেক্ষাপটেই আমার ধারণা, সাম্প্রতিক উত্তেজনাটার সূত্র এবং আমরা দুই দিকে দেখলাম দুই দেশের হাইকমিশনারকে ডাকা হচ্ছে, দুই দেশের মিশনগুলোর ওপরে আক্রমণ হওয়ার বা আক্রান্ত হওয়ার একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে, সামাজিকভাবে বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধানত কূটনৈতিক নীতিগত অবস্থান বা নীতিগত পর্যায় থেকে এগুলো ম্যানেজ করা হয়ে থাকে বা পরিচালিত হয়ে থাকে। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি, যেটা বাংলাদেশের ভেতরেও আমরা লক্ষ করছি, ভারতেও লক্ষ করছি যে, সামাজিক শক্তি অর্থাৎ জনগণ, বিভিন্ন দূতাবাস, উপদূতাবাস যেগুলো আছে, সেগুলোর ওপর কখনো কখনো হামলা, কখনো কখনো এগুলোর সামনে এসে হুমকি-ধমকি ইত্যাদি দেওয়া হচ্ছে।
কাজেই রাজনৈতিকভাবে বিষয়টাকে যথেষ্ট ম্যাচিউরিটির সঙ্গে ম্যানেজ না করার কারণেই কিন্তু এটা সামাজিক পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এবং সামাজিক পর্যায়ে যখন পৌঁছে যায়, যখন সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী এতে জড়িয়ে পড়ে, তখন কিন্তু এটা আনম্যানেজেবল হয়ে যায়। তা দুই দেশের সম্পর্কের জন্যই কিন্তু একটা আশঙ্কা তৈরি করে, যে আশঙ্কাটা এ মুহূর্তে তৈরি হয়েছে। ভারতে অনেক মিশনে আমরা ভিসা সার্ভিস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছি। ভারত এখানে অনেক আগে থেকেই ভিসা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিল এবং আমার ভয় হচ্ছে, যদি সরকারিভাবে বা নীতিগত পর্যায় থেকে এটাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সক্রিয় উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে কিন্তু দুই দেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি হবে। আমাদের জন্য আরেকটি চিন্তার বিষয় হলো, আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক ছাপিয়ে এখন বাইরের পৃথিবীতেও এটি আলোচনার বিষয়বস্তু হিসাবে তৈরি হয়েছে এবং এর মধ্যে একটা ভূ-রাজনৈতিক রং চড়াবার বা ভূ-রাজনৈতিক শঙ্কার জায়গা তৈরি হয়েছে। যেমন, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত মহোদয় দুই দেশকে আহ্বান জানিয়েছেন এ উত্তেজনা কমানোর জন্য। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা আগেও বলেছেন, এখনো বলছেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত স্থান পরিদর্শন করছেন। এর অর্থ হচ্ছে, এই দুই দেশের উত্তেজনাকে নিয়ে শুধু আমরা অস্বস্তিতে আছি তা নয়, এর বাইরেও কিন্তু আমাদের বন্ধুরা যারা আছেন, তারাও এটা নিয়ে এখন চিন্তিত। তারা চিন্তিত এ কারণে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে, ভারতের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যাদের অর্থনৈতিক যোগাযোগ আছে, ভারতের সঙ্গেও তাদের আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করেন, ভারতের সঙ্গেও করেন। এ অঞ্চলকে তাদের সম্পর্কের কারণে একটা বড় দৃষ্টিভঙ্গির বা বড় প্রেক্ষাপট থেকে এসব জিনিসকে দেখার চেষ্টা করেন। এবং যখনই এখানে উত্তেজনা তৈরি হয়, তখন তারাও চিন্তিত হন এবং তার প্রকাশ আমরা সাম্প্রতিককালে দেখেছি।