তিনি বেঁচে থাকবেন নতুন প্রজন্মের চেতনায়
‘কোনো কোনো মৃত্যু পাখির পালকের মতো হালকা, আবার কোনো কোনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের মতো ভারী।’ মৃত্যুর চলমান ঢলের মধ্যে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী এক মৃত্যু বৃহস্পতিবার রাতে আচ্ছন্ন করে পুরো বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক যুগ-সন্ধিক্ষণে, ইতিহাসের এক ভয়ংকর মোড়ে দাঁড়িয়ে যে সাহস বুক পেতে দিয়েছিল-সে বুক আজ নিথর। গণতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের লড়াইয়ের ময়দানে যে কণ্ঠ ছিল অবিচল, যে চোখে ছিল ভবিষ্যতের স্বপ্ন, সেই কণ্ঠ আজ নীরব, সেই চোখ চিরতরে বন্ধ।
সাহস, প্রতিবাদ ও দ্রোহের আরেক নাম ইনকিলাব মঞ্চের শরিফ ওসমান হাদি আর নেই। তার বয়স হয়েছিল ৩২ বছর। মৃত্যুর খবরটি প্রথমে জানানো হয় ইনকিলাব মঞ্চের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে। যেখানে বলা হয়, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের মোকাবিলায় মহান বিপ্লবী ওসমান হাদিকে আল্লাহ শহীদ হিসাবে কবুল করেছেন।’ শরিফ ওসমান হাদি ছিলেন আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী। তার মতো একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার জুলাই যোদ্ধার মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ পুরো জাতি। এমন মর্মন্তুদ খবর শুনে শোকবিহ্বল হয়ে পড়েন দেশবাসী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ তথ্য ছড়িয়ে পড়লে শোকের ছায়া নেমে আসে। বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে এ মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় অগ্নিগর্ভ হয় পুরো দেশ ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতা।
সাত দিন আগে গুলিবিদ্ধ হন তিনি রাজধানী ঢাকার বিজয়নগরে। তারপর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার চলে যাওয়া কোনো সাধারণ মৃত্যু নয়-এ এক রাজনৈতিক ক্ষয়, এক প্রজন্মের স্বপ্নে নেমে আসা গভীর অন্ধকার। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থেকেও তিনি ছিলেন বাংলার রাজপথে, মানুষের অধিকারের পাশে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এক অদম্য নাম।
জুলাই বিপ্লবের বারুদ হয়ে জ্বলে ওঠা ওসমান হাদি জানতেন-তার পথ ঝুঁকির; তার লড়াইয়ের বিপদ আছে। তবু তিনি পিছু হটেননি। বুক পেতে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন-গণতন্ত্র ভিক্ষা নয়, অধিকার। বরং ন্যায়ের পথে নীরবতা অপরাধ। তার জীবন ছিল এক জীবন্ত প্রতিবাদ আর তার মৃত্যু হয়ে উঠল এক ভারী প্রশ্ন-ছাত্র-জনতা কি সেই সাহস ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লড়াইয়ের প্রতিটি সংকটে ধরে রাখতে পারবে?
শরিফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুতে শুধু একজন মানুষ নয়, স্তব্ধ হলো একটি দীপ্ত কণ্ঠ, একটি নির্ভীক উপস্থিতি। তবু ইতিহাস সাক্ষী-এমন মানুষ কখনো পুরোপুরি মারা যান না। তারা রয়ে যান লড়াইয়ের ভাষায়, প্রতিরোধের শপথে, নতুন প্রজন্মের চেতনায়। তারা থেকে যান জন-আন্দোলনের স্মৃতিতে। তাদের সাহস মশাল হয়ে জ্বলে। স্বপ্ন প্রজ্বলিত থাকে জনমানসে এবং তাদের শূন্যতা তরুণ প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেবে-গণতন্ত্রের পথ কখনো সহজ নয়, কিন্তু সেই পথে হাঁটার মানুষ অমর।
সমকালীন বাংলাদেশের ইতিহাস স্বীকার করবে, হাদির অবদান কেবল কোনো সংগঠনের নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ ছিল না-তা ছিল একটি নৈতিক প্রতিবাদ, একটি প্রজন্মের সাহসী উচ্চারণ। শরিফ ওসমান হাদির জীবন ছিল সংগ্রাম, সাহস ও দায়বদ্ধতার এক অনন্য দলিল। তিনি রাজনীতিকে ক্ষমতার সিঁড়ি হিসাবে দেখেননি। দেখেছেন দায়িত্ব হিসাবে, আত্মত্যাগের ক্ষেত্র হিসাবে। যখন ভয় ছিল রাষ্ট্রের নিত্যসঙ্গী, যখন নীরবতা হয়ে উঠেছিল টিকে থাকার কৌশল-ঠিক তখনই তিনি কথা বলেছেন-স্পষ্ট, দ্বিধাহীন, আপসহীন কণ্ঠে।
হাদি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্র কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়-এটি চর্চা ও আত্মস্থ করার বিষয়, যা নাগরিকের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ বিশ্বাস থেকেই তিনি রাজপথে নেমেছেন, আন্দোলন গড়েছেন, তরুণদের সংগঠিত করেছেন। দমনপীড়ন, নজরদারি, হুমকি-কিছুই তাকে থামাতে পারেনি। কারণ তার সংগ্রাম ছিল না ব্যক্তিগত, ছিল সামষ্টিক মুক্তির স্বপ্নে প্রোথিত। তিনি জানতেন, ফ্যাসিবাদ কেবল একটি শাসনব্যবস্থা নয়-এটি ভয় তৈরি করে, মানুষকে একা করে দেয়। তার সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ভয়ের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সাহসের সংস্কৃতি তৈরি করতে ভূমিকা রাখা। যারা প্রথমবার রাজপথে নামতে ভয় পেত, তিনি তাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। যারা কথা বলতে দ্বিধায় ছিল, তিনি তাদের কণ্ঠে আস্থা জুগিয়েছেন।
শরিফ ওসমান হাদির সাহস প্রদর্শনমূলক ছিল না-ছিল নীরব, গভীর, দৃঢ় ও সক্রিয়। তিনি জানতেন এ সাহসের মূল্য দিতে হতে পারে জীবন দিয়েও। তবু তিনি পিছু হটেননি। বুক পেতে দিয়েছিলেন, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন-ইতিহাস কখনো নিরাপদ মানুষের কাঁধে ভর করে এগোয় না, এগোয় ঝুঁকি নেওয়া মানুষের রক্তে-ঘামে। সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও তার আহত শরীর-মন পড়েছিল দেশের দিকে, আন্দোলনের দিকে, মানুষের ভবিষ্যতের দিকে। শারীরিক দুর্বলতা তার রাজনৈতিক দৃঢ়তাকে ভাঙতে পারেনি। এ অদম্য মানসিক শক্তিই তাকে আলাদা করেছে-একজন সাধারণ কর্মী থেকে এক প্রতীকী চরিত্রে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- গুলি করে হত্যা
- শরিফ ওসমান হাদি