মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্মারক রক্ষায় অপরাধমূলক ঔদাসীন্য
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নিজের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। শেখ হাসিনা সদম্ভে বলতেন, এই দেশ তাঁর বাবা স্বাধীন করেছেন। যেন এ দেশ–তাঁর পিতার, আজীবন এ দেশ শাসন, শোষণ ও ভোগ করার অধিকার শুধু তাঁর বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অস্বীকার করার তো কোনো সুযোগ নেই।
শেখ মুজিবের ঐতিহাসিক অবদানকে আড়াল করে শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছিলেন। পরিবার-পরিজন ও ঘনিষ্ঠ নেতারা লুটতন্ত্র কায়েম করেছিলেন–যা চিরকাল চলতে পারে না, চলেওনি। ২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট তাঁর পতন ঘটেছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর ঘটে যাওয়া ভাঙচুর ও লুটপাট—বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে থাকা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙা—প্রাথমিকভাবে অনেকেই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখেছেন। আসলে, ইতিহাস এমন উদাহরণে ভরা, সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের পতনের সময় জনতা ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট ও তাঁর পিতা হাফেজ আল আসাদের ভাস্কর্য গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময়ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, এমনকি খোদ রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতেও এমন ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছিল।
২০২৪ সালের ৫ অগাস্টের অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী কয়েকদিনে দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া ধ্বংসযজ্ঞ এককথায় চরম অবিশ্বাস্য ও হৃদয়বিদারক ছিল। শুধু শেখ হাসিনা ও শেখ মুজিবের ভাস্কর্যই নয়, ভাঙচুরের শিকার হয়েছে স্বাধীনতার নানা স্মারক ও স্থাপনা—মুক্তিযুদ্ধের সাত বীরশ্রেষ্ঠের ভাস্কর্য, মুক্তিযুদ্ধের মুর্যাল, যুদ্ধদিনের স্মারক, সাধকের আখড়া, এমনকি সিনেমা হল, শিল্পাঙ্গন এবং শিশু বিকাশ কেন্দ্রও।
তারপরও ভাঙচুরের এ ধারা থামেনি। শেখ হাসিনার পতনের দিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘরও আক্রান্ত হয়েছে। একদল উন্মত্ত দুর্বৃত্তের ঘৃণ্য জিঘাংসায় ভেঙে পড়েছে দেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন। এটি কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া নয়; বরং এক ধরনের আত্মবিনাশী কর্মকাণ্ড। এমন নির্বিকার এবং হিংস্র ধ্বংসযজ্ঞ একান্তই অপরাধমূলক উদাসীনতার নিদর্শন, যা জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনছে।
অভ্যুত্থানের পরপরই স্বাধীনতার স্মৃতিস্মারক রক্ষার দাবি উঠেছিল। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন বর্তমান সংস্কৃতি উপদেষ্টা, অবশ্য তখনও তিনি শুধু চলচ্চিত্রকার মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সেই ফারুকী উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর আর এ বিষয়ে টু শব্দটি করেননি। যাই হোক এটা তাঁর সিদ্ধান্ত।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা জাদুঘর আজও ধ্বংসস্তূপ হয়ে আছে। অনুমান করা যায়, অন্তবর্তী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে কেবল শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের সম্পদ হিসেবে দেখছে। হয়তো তারা বঙ্গবন্ধুকে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার প্রতীক মনে করছেন। তাই ধন-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বা ৩২ নম্বর বাড়ির অবক্ষয় নিয়ে তারা উদাসীন। কিন্তু স্বাধীনতা জাদুঘর হলো জাতির অমূল্য সম্পদ। এই সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা ও সংরক্ষণ সরকারের দায়িত্ব।
বিস্ময়ের বিষয়, সরকার এ দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করেছে। এটি শুধু অসংবেদনশীলতার নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের প্রতি উদাসীনতা ও দায়িত্বে অবহেলার নিদর্শন—এক ধরনের অপরাধ। মার্চ মাসে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা জাদুঘরটি ঘুরে দেখলেও, আজ পর্যন্ত সংস্কারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যায়নি। এটি দেশের ইতিহাস রক্ষার প্রতি সরকারের অনীহা স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করছে।
আমি অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী বলতে চাই না কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্মারক, স্মৃতিচিহ্ন ও নানা বিষয়ে সরকার যে নির্বিকার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে যাচ্ছে তা অবশ্যই নিন্দাযোগ্য।
উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণ ও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক উদ্যানে ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ স্বাধীনতা জাদুঘর উদ্বোধন করা হয়েছিল। এটি দেশের প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একমাত্র ভূগর্ভস্থ জাদুঘর। কিন্তু আজ এটি রীতিমতো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
জাদুঘরের লম্বা পরিসরের ফ্লোরে ১৪৪টি কাচের প্যানেলে ৩০০টির বেশি আলোকচিত্র প্রদর্শিত হতো। পাশাপাশি ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পোস্টার এবং দেশে-বিদেশে প্রকাশিত সংবাদপত্রের কাটিং। সবকিছুই ভাঙচুর ও আগুনের পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জাদুঘর প্লাজার পূর্ব পাশে থাকা টেরাকোটা ম্যুরালটিও ধ্বংস হয়েছে।
অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাদুঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ছবির ফ্রেমের ভাঙা কাচের টুকরো; কোথাও আবার আগুনে পুড়ে খসে পড়া পলেস্তরা এবং তীব্র পোড়া গন্ধ। এটি শুধু একটি জাদুঘরের ক্ষয় নয়, দেশের ইতিহাসের প্রতি এক ধরনের হিংস্র অবজ্ঞার চরম নিদর্শন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড় ভুল ছিল মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বকে এককভাবে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের নামে সীমাবদ্ধ করে উপস্থাপন করা। তারই বিপরীতে এখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে সরিয়ে দেওয়ার বা মুছে ফেলার যে চেষ্টা শুরু হয়েছে, তা একেবারেই বিকৃত ও অবান্তর।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারত ও আন্তর্জাতিক সহায়তাও সেই ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত। এই প্রেক্ষাপটে কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর, স্মৃতিস্মারক বা অন্যান্য প্রতীককে অবজ্ঞা করে, তা এক ধরনের অযৌক্তিকতা—এক ধরনের মানসিক ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ। বাস্তবতাই হলো, আপনিই মানুন বা না মানুন, শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা। তার নামেই সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্লোগান দিয়েছে। অন্তবর্তী সরকার যদি বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে, তা শুধুই বাতুলতা এবং দেশের গণ-স্মৃতির প্রতি কুটিল অবজ্ঞার নিদর্শন ছাড়া আর কিছু নয়।