এ সংগ্রামেও জয়ী হয়ে ফিরে আসুন আপনি
খালেদা জিয়ার অসুস্থতায় দেশব্যাপী মানুষ যে মানবিক উৎকণ্ঠায় কাঁপছে, তা কেবল একজন সত্যিকারের জাতীয় নেতার ক্ষেত্রেই দেখা যায়। খালেদা জিয়া যে দেশের রাজনৈতিক সমাজে দলমতনির্বিশেষে আপসহীন একমাত্র নেতায় পরিণত হয়েছেন, সেটা না বললেও অনুমান করা যায়।
রাজনীতি যুক্তি দিয়ে চলে। এর মধ্যে থাকে রাজনৈতিক বিশ্বাস ও আবেগ। আর সেই আবেগ সৃষ্টি হয় তখনই, যখন সেই নেতা এমন এক রাজনৈতিক স্তরে পৌঁছে যান, যা জাতিকে প্রতিনিধিত্ব করে।
আবেগ ও বিশ্বাসের পিলার হয়ে উঠেছেন তিনি। তার জনপ্রিয়তার মূল স্তম্ভ জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতা। অনমনীয় দেশপ্রেম, কোনো অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার ভেতর দিয়ে তিনি যে রাজনৈতিক কেরিয়ার গড়ে তুলেছেন, তা একমাত্র মওলানা ভাসানীর মধ্যে আমরা দেখতে পাই। স্বৈরাচারী সরকার তাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়ার নানা ফন্দিফিকির করেছে, নানা প্রলোভন দেখিয়েছে; কিন্তু তিনি সে সবই প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ, তিনি কেবল রাজনৈতিক কারণেই দেশকে ভালোবাসেননি, দেশের জনগণের প্রতি দেওয়া তার ওয়াদাই তাকে ওই উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
এ দূরদৃষ্টি তিনি অর্জন করেছেন পারিবারিক পর্যায় থেকে এসে রাজনৈতিক পর্যায়ে জায়গা করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে। একজন গৃহবধূ থেকে দেশের সংকটকালে কেমন করে তিনি দলের হাল ধরেছিলেন এবং একজন বিচক্ষণ রাজনীতিক হয়ে উঠেছেন, তা দেশের মানুষ জানেন। বাংলাদেশের মতো একটি দারিদ্র্যপীড়িত দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায়ও যে তিনি এক মানবিক পৃথিবী গড়ে তোলার সংগ্রাম করে গেছেন, তার প্রথম প্রমাণ ছিল অপারেশন ক্লিনহার্ট। সে সময় সদ্য গড়ে তোলা র্যাবের মাধ্যমে দেশের সন্ত্রাসী ছত্রপতিদের বাসা ভেঙে দিতে শুরু হয়েছিল ওই অপারেশন। নিজেকে পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক করে তোলার লক্ষ্যে নিজ দলের ভেতরে থাকা সন্ত্রাসী ঘুনপোকাদের দমন করার মধ্য দিয়ে শুরু করা হয়েছিল অপারেশন ক্লিনহার্ট। তারপর অন্য রাজনৈতিক দলে থাকা সন্ত্রাসীদের আটক করার এক অনন্যসাধারণ পরিকল্পনা। ক্ষমতার পালাবদল হলে ওই পরিকল্পনা আর এগোয়নি। সমাজ ও রাজনীতি থেকে মুক্ত হয়নি সন্ত্রাসবাদ ও সন্ত্রাসীদের নির্মম পদচারণা। বরং তিনি ক্ষমতার বাইরে আসায় পতনশীল রাজনীতির মাথাই পচতে শুরু করে।
বিগত ১৫/১৬ বছরের রাজনীতির হিংস্র মচ্ছব আমাদের নৈতিকতাকে এতটাই ভেঙে দিয়েছে যে, মানুষ আর কোনো রাজনীতিকেই বিশ্বাসের স্তম্ভ করতে চায় না। কারণ, ওই রাজনীতি কেবল মানুষ হত্যাই করেনি, মানুষের প্রত্যাশার সব রাষ্ট্রীয় কাঠামো-অবকাঠামো ভেঙে দিয়ে তাকে লুটের সামগ্রীতে পরিণত করে। ক্ষমতাসীনদের হত্যার রাজনীতি, দমনপীড়ন-নির্যাতনের পরও যখন জাতি দেখতে পায়, সমাজকে এক ভয়ের শীতল শয্যায় নিক্ষেপ করা হয়েছে গুম, খুন, আর পুলিশি সন্ত্রাসের মাধ্যমে, তখন নিরুপায় জনগণ বিএনপির ছায়াতলে জড়ো হয়। কারণ, দলটি রাজনীতিকে জনগণের হাতে তুলে দেওয়ার অঙ্গীকার করে প্রতিবাদের মিছিল আর স্বৈরাচারের দুর্গে আঘাত হানতে শুরু করে।
ফলে স্বৈরাচারের সুবিধাভোগীরা নানারকম ফন্দিফিকির ও অপপ্রচারের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে ছিল ওই নড়বড়ে অবস্থায়। পরে এক ধাক্কায় জনগণের সুনামি তাণ্ডবে তাসের ঘরের মতো গুঁড়িয়ে যায় ফ্যাসিস্টের প্রাসাদ। ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন পার্শ্ববর্তী দেশে। প্রমাণ করেন, তিনি ছিলেন দিল্লির বাংলাদেশি প্রশাসক।
২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর জনগণের মনে যে আকাঙ্ক্ষা জন্মেছিল, তার প্রথম প্রকাশ ঘটে দ্বিতীয় স্বাধীনতার কথায়, যেন আমরা ১৯৭১ সালের ভূখণ্ডগত স্বাধীনতা অর্জন করার পরও ২০২৪-এর আগে সামগ্রিক মুক্তি আসেনি। এর আগে গণতন্ত্রের পথ অবমুক্ত হয়েছিল ১৯৭৫ সালে বাকশালের পতনের পর। আর ১৯৯১ সালে নির্বাচনে বিজয়ী খালেদা জিয়া সংসদীয় গণতন্ত্র কায়েম করার মাধ্যমে তা যেন পূর্ণতা পায়। কিন্তু দুর্ভাগ্য ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে ঘুনপোকাদের অবস্থান এতটাই পোক্ত যে, তাদের স্বার্থই যেন প্রতিফলিত হতে দেখছি আমরা।