সাহিত্যধারার পাঠ : সরল শ্রেণিকরণ ও সাহিত্যতত্ত্ব
সাহিত্যতত্ত্বের উদ্ভব ও বিকাশের গতিপথ খুঁজতে গেলে আমরা দেখব যুগে যুগে নানা ধারা-বৈশিষ্ট্য বা তত্ত্বের সৃজন ঘটেছে। ‘অধ্যয়নযোগ্য কোনও বিষয়ের ধারণাগত ভিত্তিই হলো তত্ত্ব।’ খানিকটা গভীরে খুঁজতে গেলে দেখব, ‘সাহিত্যতত্ত্ব হলো সাহিত্য হিসেবে আমরা যা পড়ি তার ধারণাগত দিক।’
আর ‘সাহিত্যতত্ত্বের ব্যবহারিক দিক হলো সাহিত্য সমালোচনা।’
গ্রিকযুগের প্লেটো কিংবা এরিস্টটলের সাহিত্যতত্ত্ব, মাইমেসিস থিওরি, ইটালির হোরেস কিংবা লঙ্গিনাসের সাবলাইম তত্ত্ব, পরবর্তীকালে ধারাবাহিকভাবে চলে এসেছে নিওক্লাসিসিজম, রোমান্টিসিজম, নিউ ক্রিটিসিজম, ফরমালিজম বা আঙ্গিকবাদ, বাখতিনিজম, রিডারস রেসপন্স থিওরি, স্ট্রাকচারালিজম বা কাঠামোবাদ, পোস্ট স্ট্রাকচারালিজম ও বিনির্মাণবাদ, মার্কসীয় সাহিত্যতত্ত্ব, মনোসমীক্ষণবাদী সাহিত্যতত্ত্ব, নারীবাদী সাহিত্যসমালোচনা সর্বোপরি আধুনিকতাবাদ ও উত্তর আধুনিকতাবাদ। অর্থাৎ দেখা যায় ভাবনাতত্ত্ব, যুক্তিবাদ, রিয়ালিজম, সুররিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম, সেন্টিমেন্টালিজম কিংবা রোমান্টিক যুগের কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে কোথাও সাহিত্যের সংজ্ঞা স্থায়ীভাবে আসন গ্রহণ করে থাকেনি। তবে একেকটা মতবাদ একেক দিকে আলো ছড়িয়েছে। সাহিত্যতত্ত্ববিদেরা এসব মতবাদ জানেন, আগ্রহী লেখকেরাও এসবের ভেতর থেকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে উন্নত করতে পারেন, করেনও। সাধারণ পাঠকের কি এগুলো জানা উচিত, বা জানার প্রয়োজন আছে?
প্রয়োজন থাকুক কিংবা না থাকুক, উল্লিখিত মতবাদ থেকে অন্তত দুটি বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কারণে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমে তুলে ধরছি নিওক্ল্যাসিসিজম বিষয়ে―শব্দটির অর্থ হলো, ‘ক্ল্যাসিকসের ভিত্তিতে দাঁড় করানো সাহিত্যভাবনা।’
মূলত গ্রিক ও রোমান কথাকারদের সাহিত্যভাবনা বা সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছে নিওক্ল্যাসিসিজম বা নব্যধ্রুপদীবাদ। ওই কালটাকে সাহিত্যবিষয়ক ফতোয়ার কালও বলা যেতে পারে। এ সময় কোনটা সাহিত্য বলে বিবেচিত হবে তা মূলত নির্ভর করত গ্রিক ও রোমান ক্ল্যাসিক পণ্ডিতদের গ্রহণ ও বর্জনের ওপর। ওই সময়টি সাহিত্য-শাসনের যুগ হলেও ক্ল্যাসিকসের অন্ধ অনুকরণ সাহিত্যে কল্পনার জায়গা ব্যাপকভাবে সংকুচিত করে ফেলে নিওক্ল্যাসিকাল যুগ। ফলে বিপুল শক্তিধর তাত্ত্বিকদের এই চর্চার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণার মধ্য দিয়ে জন্ম হলো ‘রোমান্টিসিজম’ নামের নতুন সাহিত্যভাবনা বা সাহিত্যতত্ত্ব। শব্দটির উদ্ভব হয়েছে রোম (Rome) থেকে। রোমের লাতিন থেকে উদ্ভব হয়েছে ইউরোপের অনেক ভাষা―যেমন পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, ফরাসি, ইতালিয়ান ইত্যাদি। সব কটি ভাষাকে এক নামে রোমান্স (Romance) ভাষা বলা হয়।
‘রোমান্স’ শব্দটি ইতালির রাজধানী রোম বলয় থেকে বেরিয়ে একটি সাহিত্যধারার মুকুট পরে নেয়। এই ধারায় অবিশ্বাস্য বীরের গল্প থাকত, সতী নারীর প্রেমের বিষয় থাকত, জিন-পরি জগতের চরিত্ররাও হাজির হতো। আজগুবি, কল্পিত, যুক্তিহীন বানানো কাহিনি থাকত। সাহিত্যে এ সময়কালটা মধ্যযুগীয়, রেনেসাঁস-এর আগের। এসব আখ্যান পাঠককে আনন্দ দিত, আজগুবি আর কল্পনাজাত বলে কেউ এগুলো ছুড়ে ফেলে দেয়নি, মিথ্যা বা যুক্তিহীনতার দায়ে অভিযুক্তও করেনি। কিন্তু নিওক্ল্যাসিকাল যুগে যা কিছু কল্পনায় সৃজন করা হয়েছে, লালন করা হয়েছে তাকেই মূর্খতা উপাধি দিয়ে বর্জন শুরু হয়েছিল। অপরদিকে ক্ল্যাসিকাল যুগের যুক্তিবুদ্ধিচর্চাকে সাহিত্য ও সমাজ দুইয়ের জন্য আবশ্যিক করে তুলেছিল। প্লেটো-অ্যারিস্টটলের মাইমেসিস থিওরিকে খানিকটা চ্যালেঞ্জ করল। মাইমেসিস থিওরিতে অ্যারিস্টটল যেমন বলেছেন, ‘সাহিত্য হলো জীবন ও জগতের অনুকৃতি (imitation)’― তাঁদের এই ক্ল্যাসিকাল এবং নিওক্ল্যাসিকাল মতাদর্শকে আমূল পাল্টে দিয়ে রোমান্টিকরাই কল্পনায় সৃজনক্ষমতা অবলম্বন করে সর্বপ্রথম দেখিয়ে দিল যে, সাহিত্যের কাজ অনুকরণ নয়; সৃজনও।
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে এখানে উল্লেখ করার প্রয়োজন এই যে, কল্পনাশক্তি এবং সৃষ্টিশীল ক্ষমতা মানুষের মেধার উপাদান, অঙ্গ। মেধার অন্যান্য অনুষদের মধ্যে আছে মেমোরি, অর্থপূর্ণ উপলব্ধি এবং যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা, সমস্যার সমাধান এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। একজন সৃজনশীল লেখক এসব অনুষদ ব্যবহার করে সৃজন করতে পারেন যাপিত সমাজে জীবনঘনিষ্ঠ আখ্যান, অমর সাহিত্যভান্ডার।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বিকাশ
- চর্চা
- শিল্প-সাহিত্য