প্রতিবন্ধিতা ও সম্ভাবনার নতুন দুয়ার
আইনস্টাইনের পরে যে বিজ্ঞানী আমাদের সময়ে বিশ্বকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করছেন তিনি হলেন স্টিফেন হকিং। মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব এবং মহাজাগতিক ঘটনাবলীর ব্যাখ্যায় হকিং এখনো অগ্রণী বিজ্ঞানী। একুশ বছর বয়সে তিনি দুরারোগ্য মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হন।
বিজ্ঞাপন
ধীরে ধীরে তার শরীরের প্রায় সবটুকু অবশ বা প্যারালাসিস হয়ে যায়। তিনি পঙ্গু ও বাকহীন হয়ে পড়েন। কিন্তু শারীরিক সব অসামর্থ্যকে অতিক্রম করে নিজেকে তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, মহাকাশ বিজ্ঞানী, লেখক এবং শিক্ষক হিসেবে গড়ে তোলেন।
প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। শারীরিক সামর্থ্যহীনতা সেই সম্ভাবনার বিকাশে বাঁধা সৃষ্টি করতে পারে না। তবে সেজন্য একটি সহায়ক পরিবেশ, সঠিক শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ ইত্যাদির প্রয়োজন হয়।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবন্ধী বলতে আমরা কি বুঝি? প্রতিবন্ধী বলতে আমরা সেইসব মানুষকে বুঝি যারা রোগ, দুর্ঘটনা, আঘাত বা অন্য কোনো কারণে শারীরিক বা মানসিক অথবা উভয়ভাবে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে স্থায়ী কর্মক্ষমতাহীন ও স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম হয় যায়। এই অক্ষমতা বা অসামর্থ্য শারীরিক, মানসিক, দৃষ্টি, শ্রবণ, বাক, অটিজম এবং অন্যান্য ধরনের হতে পারে।
শরীরের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে অক্ষম ব্যক্তিকে শারীরিক প্রতিবন্ধী বলা হয়। যে মানুষ মানসিক ভারসাম্যহীনতার কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না তাকে মানসিক প্রতিবন্ধী বলা হয়।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর দৃষ্টি ক্ষমতা আংশিক বা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকে। এজন্য সে সমাজের আর দশটা মানুষের মতো যাবতীয় কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়। এভাবেই শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধীর শোনার এবং কথা বলার আংশিক বা পূর্ণ অসামর্থ্য থাকে।
তবে অটিজম হচ্ছে মানুষের বিকাশমূলক প্রতিবন্ধিতা যার কারণে একজন ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ এবং স্বাভাবিক আচরণে অসমর্থ হয়। প্রতিবন্ধিতা শুধু একটি ক্ষেত্রে (যেমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী) হতে পারে। আবার সেটা যৌগিক ধরনের অর্থাৎ একের অধিক প্রতিবন্ধিতা একসাথে হতে পারে।
যেমন বিখ্যাত লেখক এবং মানবতাবাদী হেলেন কেলার একইসাথে অন্ধ এবং বধির ছিলেন। আমাদের চারপাশে বহু মানুষ আছেন যারা একসাথে চার, পাঁচ বা ছয় ধরনের প্রতিবন্ধিতা নিয়ে জীবনযাপন করছেন।
বহু বছর ধরে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীদের দেশ এবং সমাজের বোঝা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। অনেক সমাজে প্রতিবন্ধিতাকে পাপের ফল, অভিশাপের ফল, ওপরওয়ালার শাস্তি, ভূত-প্রেতের কু-নজর,খারাপ বাতাস লাগা, চোখ লাগা, বান মারা, জিনে ধরা, তাবিজ করা ইত্যাদি নানা ধরনের কুসংস্কার দ্বারা ব্যাখ্যা করা হতো।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হতো। ক্ষেত্র-বিশেষে প্রতিবন্ধী শিশু, বৃদ্ধ বা ব্যক্তিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার উদাহরণও রয়েছে। অবশ্য প্রচলিত কুসংস্কারের সাথে দারিদ্র্যের সহযোগ ঘটলে নিষ্ঠুরতার ঘটনা বেশি ঘটে।
জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতি, প্রযুক্তির উন্নয়ন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিকাশ, মানুষের অধিকার বিষয়ক বোধের বিস্তার ইত্যাদির মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পেরেছি প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে সম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব। এছাড়া বিশ্ববাসীর চোখের সামনে স্টিফেন হকিং, হেলেন কেলারসহ শত শত কৃতি মানুষের উদাহরণ জ্বল জ্বল করে আলো ছড়াচ্ছে।
প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তদ্রূপ প্রতিবন্ধীদের মধ্যেও আছে অমিত সম্ভাবনার আকর। সঠিক, কার্যকর শিক্ষা ও যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব।
এজন্য একদিকে দরকার শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ ও লাগসই প্রযুক্তির সহায়তা, অন্যদিকে প্রয়োজন প্রতিবন্ধীদের জন্য কর্ম সহায়ক পরিবেশ, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং চারপাশের মানুষের সহযোগিতার মনোভাব। মূলত এই কাজটি করার জন্য ১৯৯২ সাল থেকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্রতি বছরের ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালন করা হয়।
জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ‘সমাজ ও উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার, কল্যাণ ও সুযোগ নিশ্চিত করা এবং তাদের জীবনযাত্রার মান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস