দক্ষতার সংকটে আমাদের শ্রমবাজার : এখনই নজর দিন
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বহুবিদ চ্যালেঞ্জের মুখে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ‘দক্ষতার সংকট’। এই দক্ষতার অভাবটিই দেশে-বিদেশে প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশে প্রতিবছর লাখ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এদের একটি বড় অংশই আধুনিক শিল্প ও প্রযুক্তিভিত্তিক কর্মক্ষেত্রে কাজের উপযোগী নয়। ফলে একদিকে বেকারত্ব বাড়ছে, অন্যদিকে দক্ষ জনবলের অভাবে শিল্পকারখানায় উৎপাদনশীলতা কমছে।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই আধুনিক শিল্প, সেবা বা প্রযুক্তি খাতে কাজে দক্ষ। সিংহভাগেরই কারিগরি দক্ষতা, তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞান, ভাষা ও পেশাগত আচরণের অভাব সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। জরিপ বলছে, বাংলাদেশের ৮৭ শতাংশ শ্রমিক অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ; তাদের মধ্যে অনেকেই কৃষি বা নিম্নআয়ের সেবা খাতে কাজ করেন। অথচ আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে (বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া বা ইউরোপে) দক্ষ কর্মীর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
আমাদের দেশে দ্রুত বাড়ছে তৈরি পোশাক, আইটি, নির্মাণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা ও হসপিটালিটি খাতে দক্ষ জনবলের প্রয়োজনীয়তা। অথচ এসব খাতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিদেশ থেকে উচ্চ বেতনে প্রশিক্ষিত শ্রমিক এনে অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার চেষ্টা করছে- যা অর্থনীতির জন্য বড় প্রতিবন্ধকতাই বটে।
দেশের শিক্ষাব্যবস্থাও শ্রমবাজারের বাস্তব চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও বড় অংশে তাত্ত্বিক শিক্ষা দেয়; হাতে-কলমে শেখা, প্র্যাকটিক্যাল স্কিল বা ‘ইন্ডাস্ট্রি লিংকেজ’ প্রায় নেই বললেই চলে। যেসব শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিকের পর কর্মজীবনে প্রবেশ করতে চায়, তাদের জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এখনও পর্যাপ্ত নয়। দেশে প্রায় ১৫ হাজারের বেশি স্কুল ও কলেজ থাকলেও টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট সংখ্যা প্রায় দুই হাজার। এগুলোর অধিকাংশেই আধুনিক সরঞ্জাম, প্রশিক্ষক ও মানসম্পন্ন কোর্সের ঘাটতি রয়েছে। এই ঘাটতির কারণে, শ্রমবাজারে যে দক্ষতার চাহিদা তৈরি হচ্ছে, সেই ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের তরুণরা প্রস্তুত নয়।
রেমিট্যান্স আয় আমাদের অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ। কিন্তু দুঃখজনক হলও সত্য যে, যারা বিদেশে যাচ্ছেন, তাদের ৭০ শতাংশই অদক্ষ শ্রমিক। ফলে তারা কম বেতন পান, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত হন। বিদেশে প্রতিযোগিতামূলক শ্রম শিল্পে টিকতে পারেন না। অন্যদিকে, ফিলিপাইন, ভারত, ভিয়েতনাম, নেপাল বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলো দক্ষশ্রমিক তৈরি করেন শ্রমবাজারমুখী। তারা এই দক্ষশ্রমিক বিদেশে পাঠিয়ে বেশি রেমিট্যান্স অর্জন করছে। বাংলাদেশ যদি এই দিকটি গুরুত্ব দিয়ে দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি বাড়ায়, তবে অল্প সময়েই বিদেশে উচ্চ বেতনের কাজ পাওয়া সম্ভব হবে। এতে একদিকে আমাদের রেমিট্যান্স বাড়বে, অন্যদিকে কমবে বেকারত্ব।
আরেকটা বিষয় এখানে স্পষ্ট যে, নারীদের অংশগ্রহণও এখন এই খাতে সীমিত হয়ে যাচ্ছে। শ্রমশক্তিতে তাদের অংশ এখন মাত্র ৩৬ শতাংশের মতো। অনেক নারী গার্মেন্টস খাতে কর্মরত থাকলেও তাদের নতুন শিল্প ও সেবা খাতে প্রবেশের সুযোগ কম। তাই ডিজিটাল স্কিল, ফ্রিল্যান্সিং, হেলথকেয়ার, ফুড প্রসেসিং বা কুটির শিল্পে নারীদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে। আমি মনে করি, দক্ষ নারীশক্তি গড়ে তুলতে পারলে শুধু কর্মসংস্থানই বাড়বে না, বরং পরিবার ও সমাজে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দক্ষতা
- সংকট
- বাংলাদেশের শ্রমবাজার