সেনাকুঞ্জে হেমন্তের এক বিকালে
গত ২১ নভেম্বর যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ও উৎসব-উদ্দীপনায় ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ পালিত হয়। ১৯৭১-এর এই দিনে আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর বীর সেনানীরা জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জল, স্থল ও অন্তরিক্ষে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণের সূচনা করেছিল, যা ত্বরান্বিত করে ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়কে।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অন্যতম আকর্ষণীয় ও আলোচিত বিষয় হলো এ দিবস উপলক্ষ্যে ঢাকা সেনানিবাসস্থ সেনাকুঞ্জে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। প্রতিবছরের মতো এবারও ২১ নভেম্বর পাতাঝরা হেমন্তের সোনালি বিকালে সেনাকুঞ্জের সবুজ চত্বরটি সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা ও দেশি-বিদেশি অতিথিদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল।
সেনাকুঞ্জের সাতকাহন : সেনাকুঞ্জটি ঢাকা সেনানিবাসের প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত। অত্যন্ত উন্নতমানের এই ‘বহুমুখী মিলনায়তন ও সিভিল কমপ্লেক্সটি’ নির্মিত হয়েছিল ১৯৮৯ সালে; তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান লে. জেনারেল এম আতিকুর রহমানের অসাধারণ উদ্যোগে। রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮৯ সালের ২১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে এটি উদ্বোধন করেন। এ নির্মাণের পেছনে বিশেষ উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন তিনি।
সেনাকুঞ্জের দক্ষিণেই কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব, যেন ঢাকায় একখণ্ড নয়নাভিরাম ‘সুইজারল্যান্ড’। উত্তরদিকে সবুজ বৃক্ষরাজি ও অপরূপ সরোবর। এর ঠিক পূর্বদিকে ২০১৫ সালে নির্মিত হয়েছে ‘সেনামালঞ্চ’ নামের আরেকটি আলোচিত ও নজরকাড়া কনভেনশন হল ও সম্মেলন কেন্দ্র। উল্লেখ্য, ‘সেনামালঞ্চ’ তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ইকবাল করিম ভূইয়ার উদ্যোগে নির্মিত হয়। অপরূপ স্থাপত্যময় সেনাকুঞ্জের পশ্চিমদিকে বিশাল খোলা চত্বর। মূলত এ বিরল খোলা চত্বরের সম্মুখে ঘাসের সবুজ গালিচায় আয়োজন করা হয়েছিল ২১ নভেম্বরের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।
বিপ্লবী কবি নির্মলেন্দু গুণ ১৯৯৮ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। সেনাকুঞ্জের নজরকাড়া নির্মাণশৈলী, মূল ভবনের সামনে দেওয়ালে আঁকা ম্যুরাল চিত্র তাকে মুগ্ধ করেছিল। এ অভিজ্ঞতার ওপর নির্মলেন্দু গুণ ‘সেনাকুঞ্জে কিছুক্ষণ’ নামে চমৎকার একটি গ্রন্থ লেখেন।
প্রবেশমুখে বেশ ভিড় সামলে স্থাপত্য নিবিড়, চমৎকার ল্যান্ডস্কেপিং-শোভিত সেনাকুঞ্জে সস্ত্রীক পৌঁছালাম বেলা প্রায় আড়াইটায়। ততক্ষণে সামরিক কর্মকর্তা ও আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমনে সংবর্ধনাস্থল অনেকটা পূর্ণ হয়ে গেছে।
সেনাকুঞ্জের সামনের প্রায় মাঝখানে নির্মিত হয়েছে অস্থায়ী অনুষ্ঠান-মঞ্চ। সেনাকুঞ্জের একেবারে শীর্ষে বড় করে লেখা হয়েছে-‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস-২০২৫’। হেমন্ত বিকালের কমলা আলোয় সেনাকুঞ্জকে অসাধারণ দৃশ্যময় এক ইমারত বলে মনে হয়। এর মধ্যে ঐতিহ্যবাহী সামরিক ব্যান্ডে (সম্মিলিত বাদক দল) চলতে থাকে মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের গানের সুর। একপর্যায়ে সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রমের ওপর প্রামাণ্যচিত্রও দেখানো হয়।
অপরূপ অপরাহ্নের সম্মিলনী : পড়ন্ত বিকালের আলোয় মোহময়ী হয়ে উঠেছিল সেনাকুঞ্জ। এই বিশেষ দিনে সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তারা পরিধান করেছিলেন নিজ নিজ বাহিনীর ঐতিহ্যবাহী আনুষ্ঠানিক পোশাক বা সার্ভিস ড্রেস। সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে এসেছিলেন বহু বর্ণিল শাড়ি-শোভিত তাদের জীবনসঙ্গিনীরা। কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ‘সেনাকুঞ্জে কিছুক্ষণ’ গ্রন্থে সামরিক কর্মকর্তাদের এমন সমাবেশকে ‘নিষ্পাপ মুখশ্রীর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল সৈনিক’ এবং ‘তারকাখচিত সুদর্শন সৈনিক’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
অনুষ্ঠানে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ-সদস্যরা, মুক্তিযোদ্ধা, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, নাগরিক সমাজের ব্যক্তিরা, ছাত্রনেতা ও বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট নাগরিক, কূটনীতিক এবং তিন বাহিনীর চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
ততক্ষণে সেনাকুঞ্জের খোলা চত্বরের সামনে সবুজাভ ঘাসের গালিচায় আমন্ত্রিত নাগরিক ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে। তাদের মধ্যে ঐক্য, আন্তরিকতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের চমৎকার আবহ তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের অনুষ্ঠান আমাদের জনগণ ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে একতা, ভ্রাতৃত্ব ও একাত্মতার মূর্তপ্রতীক হয়ে ওঠে। যেমনটা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সময়।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ : বিকাল প্রায় ৪টার দিকে ফ্যানফেয়ারে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার আগমনি বার্তা ঘোষিত হয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মঞ্চে এসে পৌঁছালে সামরিক ব্যান্ডে বেজে ওঠে আমাদের জাতীয় সংগীত। এরপর প্রধান উপদেষ্টা বক্তৃতা শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও চলমান দেশ পুনর্গঠন ও সংস্কারের কাজেও সশস্ত্র বাহিনী বরাবরের মতোই মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে অব্যাহতভাবে দেশের মানুষের আস্থার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি-গণতান্ত্রিক এবং নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি অনুগত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী তাদের পেশাগত দক্ষতা ও দেশপ্রেমের সমন্বয়ে দেশের জন্য ত্যাগ ও তৎপরতার এ ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে আসন্ন নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে বিবেচিত হবে। একটি নির্বিঘ্ন ও উৎসবমুখর নির্বাচন আয়োজনে আমি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের দক্ষতা ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাচ্ছি...।’
- ট্যাগ:
- মতামত
- উদযাপন
- সশস্ত্র বাহিনী দিবস