আইনি আদালতের আগে জনতার আদালতেই পরাজিত শেখ হাসিনা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) বিচারে শক্তিশালী অংশ বা দুর্বলতা কী—সেগুলো নিয়ে আইন বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করবেন। আমাদের আলোচনার বিষয় হলো, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পতন এবং জনগণের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কাছ থেকে তিনি 'দোষী সাব্যস্ত' হয়েছে অনেক আগে—২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সেই অভ্যুত্থানের দিনগুলোতেই।
ভবিষ্যৎ সবসময়ই অনিশ্চিত। কিন্তু বর্তমানে তার খ্যাতি ভেঙেচুরে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে; তার রাজনৈতিক জীবন দাফন হয়ে গেছে অহংকার, আত্মম্ভরিতা, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও পুলিশ-প্রশাসনকে মাথায় তুলে রাখার সংস্কৃতির নিচে। হাসিনার পতনের কারণ হিসেবে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের যে ব্যাখ্যাই আওয়ামী লীগ দিক, বাস্তবতা হলো আইসিটি ঘোষিত 'মৃত্যুদণ্ড' মূলত তিনি নিজেই ডেকে এনেছিলেন রাজনৈতিক ভিন্নমতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন, আইনের অপব্যবহার, দুর্নীতি, দলীয়করণ করে প্রশাসন পরিচালনা, ব্যাংক লুট, অর্থপাচার, স্বাধীন গণমাধ্যমকে দমন ও অনুগতদের দুর্নীতিতে প্রলুব্ধ করা এবং শেষ দিকে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য শিশুসহ অন্তত ১ হাজার ৪০০ নাগরিককে হত্যা করে। বছরের পর বছর গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তার শাসনামলের পরিচয়চিহ্নে পরিণত হয়েছিল। হ্যাঁ, কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও বেশকিছু সামাজিক সূচকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কিন্তু গণতন্ত্র ধ্বংস করা ও অপ্রতিরোধ্য স্বৈরাচারী শাসনের কারণে সেসব কৃতিত্ব সম্পূর্ণ ঢাকা পড়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা একেবারে ধসে পড়ে এবং তার প্রতি ঘৃণা আকাশচুম্বী হয়ে উঠে। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষকে হত্যা করায় জনগণের আদালতে তার 'মৃত্যুদণ্ড' ঘোষিত হয় বহু আগেই। অনেক স্বৈরশাসক ও একনায়কের তুলনায় তার শাসনামলের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এতো অল্প সময়ে এত বিপুলসংখ্যক নিরস্ত্র প্রতিবাদকারীকে হত্যা করার নজির খুব কমই আছে।
হাসিনার কৃতিত্ব হলো, ২১ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর দলকে পুনর্গঠিত ও পুনরুজ্জীবিত করে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী করতে পেরেছিলেন। প্রথম মেয়াদে বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (যা তিনি নিজেই বাস্তবায়ন করেননি) ও গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তি আওয়ামী লীগের জন্য নতুন যুগের সূচনা করেছিল। কিন্তু বছর গড়িয়ে তিনি কার্যত নিজের দলকেই ধ্বংস করেন—যেভাবে তিনি পুলিশ, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থাকেও ধ্বংস করেছেন। দলকে তিনি রূপান্তরিত করেন এক রাজনৈতিক শক্তিকেন্দ্র থেকে চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও সহিংসতার যন্ত্রে। আদর্শের জায়গায় তোষামোদ, নীতির জায়গায় নেতার প্রশস্তি, আর জনগণের সেবা করার পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির পথে ধাবিত হন। প্রতিটি মনোনয়ন বিক্রি করা হয়েছে, দলীয় পদোন্নতি হয়েছে ঘুষের বিনিময়ে এবং সব উন্নয়ন প্রকল্পকে মনে করত নিজেদের সম্পত্তি। আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠনটি কীভাবে হত্যায় লিপ্ত এক দলে পরিণত হয়েছিল তার অকাট্য প্রমাণ হলো বুয়েট শিক্ষার্থী আবরারের ওপর ছাত্রলীগের নির্যাতন ও হত্যা।
১৯৯১ ও ২০০১ সালের নির্বাচন দুটিতে আওয়ামী লীগের পরাজয় তিনি মেনে নিতে পারেননি। তার বিশ্বাস, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ কখনোই হারে না; আওয়ামী লীগ তখনই হারে, যখন কারচুপির মাধ্যমে তাদের হারানো হয়। তিনি সেই নির্বাচনগুলোতে 'সূক্ষ্ম কারচুপি' হয়েছে দাবি তুলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন। এখান থেকেই শুরু হয় তার অহংকার ও সংকীর্ণতার—যা থেকে তিনি সত্যকে অগ্রাহ্য এবং ভয়াবহ ভুল করতে থাকেন।
২০০৪ সালের আগস্টে প্রাণঘাতী গ্রেনেড হামলা থেকে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী নিহত হন। এই হামলার তদন্ত বা বিচারের কোনো বিশ্বাসযোগ্য উদ্যোগ নেয়নি তৎকালীন বিএনপি সরকার। সেখান থেকে হয়তো হাসিনা বিশ্বাস করতে শুরু করেন, বিরোধীদলে থাকলে তিনি সবসময় ঝুঁকিতে থাকবেন এবং একবার ক্ষমতায় যেতে পারলে আর কখনো ছাড়বেন না। আমাদের দৃষ্টিতে, এখান থেকেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মৃত্যু শুরু।
২০০৮ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ক্ষমতায় ফিরে ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেন হাসিনা। এরপর কারচুপির মাধ্যমে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফল নিজের মতো করে নেন। প্রতিবার কারচুপির পর তার আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে এবং তিনি মনে করতে থাকেন যে রাজনৈতিক মিত্ররা তার ঘুঁটি, প্রতিপক্ষ সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য এবং ভিন্নমত খুব সহজেই দমন করা সম্ভব। তিনি ভুল স্বীকার না করার মানসিকতায় আটকে যান এবং সীমাহীন অহংকারী হয়ে উঠেন।
২০১৩ সালে সম্পাদকদের এক বৈঠকে তাকে বলতে শুনেছিলাম, 'আমাকে হত্যার এত চেষ্টা সত্ত্বেও আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তার ইচ্ছা পূরণের জন্য। কাজেই আপনারা যা খুশি লিখুন, আমি পরোয়া করি না।' তিনি মনে করতেন, স্রষ্টাই তাকে পথ দেখাচ্ছেন, তাই চিন্তার কিছু নেই। এভাবে তিনি একদিকে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, অপরদিকে হয়ে ওঠেন আরও অসহিষ্ণু। ফলে, তিনি জনগণ ও নিজ দলের কাছ থেকে দূরে সরে যান।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে সংবিধান পরিবর্তন করার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হলো যে হাসিনা জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া নিজের হাতে তুলে নিতে যাচ্ছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে প্রকাশ্যে নির্লজ্জ কারচুপি করা হয় এবং সেটা ছিল সবার সামনে একেবারে স্পষ্ট। আমরা আগেও লিখেছি, কিন্তু আবার উল্লেখ করা প্রয়োজন—৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে একক প্রার্থী ছিলেন, কারণ বাকিরা 'স্বেচ্ছায়' সরে দাঁড়ান। ফলে নির্বাচন কমিশন সেই একক প্রার্থীদের বিজয়ী ঘোষণা করে, যারা সবাই আওয়ামী লীগের। অর্থাৎ ২০১৪ সালের নির্বাচনে একটি ভোটও না পড়ার আগেই সরকার গঠনের জন্য সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগ। এটি ছিল নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেপরোয়া, অগণতান্ত্রিক ও অনৈতিক হস্তক্ষেপ। ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা ছাড়া এটা কি সম্ভব?