হাসিনার সাজার পর আওয়ামী লীগের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী
একটা দৃশ্যকল্পের কথা ভাবা যায়। একদা নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী প্রবল প্রতাপে দেশ শাসন করেছেন বছরের পর বছর। একটি অভ্যুত্থানে তাঁর পতন হয়। তাঁর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ ওঠে। তাঁকে দেওয়া হয় মৃত্যুদণ্ড। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফাঁসির মঞ্চের দিকে। যেতে যেতে তিনি ভাবছেন—কী তাঁর অপরাধ! তাঁর এই ভাবনার প্রতিফলন দেখি এক ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের লেখায়। তাঁর ‘দ্য প্যাট্রিয়ট’ কবিতাটি একটি বার্তা দেয়—একজন দেশপ্রেমিক একদিন প্রশংসিত হলেও পরদিন তার পতন হতে পারে।
কবিতাটির একটি অংশের সরল বাংলা অনুবাদ এ রকম :
‘বৃষ্টির জলে ভিজে আমি বধ্যভূমির পথে ধাবিত, শক্ত রশি দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দুটো কেটে যাচ্ছে বুঝি, অনুমান করছি বুঝিবা কপাল থেকেও রক্ত ঝরছে, যার ইচ্ছা হচ্ছে সে-ই পাথর ছুড়ে মারছে আমাকে লক্ষ্য করে, এক বছরে এ–ই আমার কর্মফল।
এমনই আমার আগমন আর নির্গমন! এমনই আমার এক বছরের কর্মের পরিণাম।’
নজরুলের একটি গানে আছে তার প্রতিধ্বনি—‘আজিকে যে রাজাধিরাজ কাল সে ভিক্ষা চায়, চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।’ ইতিহাসে রাজসিক উত্থান আর বিয়োগান্ত পতনের ভূরি ভূরি নজির আছে। ইতিহাস থেকে আমরা কেউ শিক্ষা নিই না।
ঢাকার ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছেন। তিনি দেশে নেই। আছেন নয়াদিল্লিতে। ভারত সরকার তাঁকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে। দণ্ডাদেশ মাথায় পেতে নিতে তিনি ঢাকায় আসবেন না। তিনি অডিও-ভিডিও বার্তায় বিজয়ীর বেশে ফিরে আসার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তিনি নিজেকে এখনো নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মনে করেন। তিনি আরও মনে করেন, ষড়যন্ত্র করে তাঁকে উৎখাত করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ নামের একটি রাজনৈতিক দলের তিনি প্রধান নেতা। দলটির বয়স ৭৬ পেরিয়েছে। শেখ হাসিনা এই দলের সভাপতি প্রায় ৪৭ বছর ধরে। বিরোধী দলের নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন প্রায় ২৭ বছর। রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহীর ক্ষমতা হারালেও আলোচনার শীর্ষে আছেন এখনো। তাঁকে নিয়ে অনেক সমালোচনা থাকলেও দলের মধ্যে তিনি ঈশ্বরতুল্য। সেখানে তাঁর কোনো শরিক নেই। দেশ থেকে চলে যাওয়া বা পালানোর ১৫ মাস পরও আওয়ামী লীগ বলতে শুধু তাঁকেই বোঝায়। প্রশ্ন হলো, এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ কী?
খাদে পড়ে যাওয়ার পর আবার উঠে দাঁড়ানোর একাধিক উদাহরণ আছে দেশে-বিদেশে। আওয়ামী লীগ কি আবারও রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াতে পারবে? প্রশ্নটি জাগে এ কারণে যে একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও ব্যক্তিনির্ভর দলের প্রধান যখন দৃশ্যপটে নেই, তখন তাঁর অনুপস্থিতিতে দল টিকবে কি না।
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে এক ব্যক্তির শাসন কায়েম হয়েছিল। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। জনতা ভালোবেসে তাঁকে বলত বঙ্গবন্ধু। জননেতা মুজিব আর শাসক মুজিবকে এক পাল্লায় মাপা যায়নি। আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও তিনি সুশাসন দিতে পারেননি। তিন বছরের মাথায় বদলে গিয়েছিল চালচিত্র। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এক সেনা অভ্যুত্থানে তিনি নিহত হলেও তাঁর দল স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেনি।
শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ আবার উঠে দাঁড়িয়েছিল। এর পেছনে তৎকালীন শাসকদের প্রশ্রয় বা অনুকম্পা ছিল। তাঁরা দলটিকে নিষিদ্ধ করেননি। ২০২৫ সালে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বর্তমান শাসকেরা এ দলটির প্রতি ততটা উদার নন, যতটা ছিলেন ১৯৭৫-পরবর্তী শাসকেরা। বিধিনিষেধ না তুলে নিলে আওয়ামী লীগের ফিরে আসার নিশ্চয়তা ক্ষীণ। প্রশ্ন হলো, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় চাপ সৃষ্টি করে দলটি আবার প্রকাশ্য হওয়ার সুযোগ তৈরি করতে পারবে কি না।