দিনটি স্বাধীনতার রণাঙ্গনে তিন বাহিনীর ঐক্যের স্মারক
বাংলাদেশে প্রতিবছর ২১ নভেম্বর পালন করা হয় সশস্ত্র বাহিনী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা প্রথমবারের মতো একযোগে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিতভাবে আক্রমণ পরিচালনা করেন। এ ঐতিহাসিক ঘটনার স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতেই দিনটি জাতীয়ভাবে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রাথমিকভাবে প্রতিরোধ আন্দোলনের আকারে শুরু হয়, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় বাঙালিদের ওপর প্রাথমিকভাবে দমন অভিযান পরিচালনা করে এবং পরবর্তীকালে এটি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে, বর্তমান বাংলাদেশে বিস্তৃত হয়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশ বাহিনী, যা সাধারণত মুক্তিবাহিনী (মুক্তিযোদ্ধা) নামে পরিচিত, গেরিলা যোদ্ধাদের ছোট ছোট দল গঠন করে, যারা ‘হিট অ্যান্ড রান’ কৌশল অনুসরণ করে। যুদ্ধের তৃতীয় পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা তাদের নিজ নিজ ইউনিট ত্যাগ করে বাংলাদেশ বাহিনীতে যোগদান করে এবং সীমান্তের ওপারে নিয়মিত ইউনিটে তাদের সংগঠিত করে প্রাথমিকভাবে স্থলবাহিনী হিসাবে। নৌ কমান্ডোদের একটি ছোট দল নৌ শাখাও খুলেছিল এবং কয়েকজন পাইলট এবং বিমানসেনা বিমান শাখা গঠন করেছিল।
দীর্ঘ গেরিলা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ বাহিনী কয়েক মাস ধরে অব্যাহতভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। বাংলাদেশ বাহিনীকে তিনটি ব্রিগেড আকারের যুদ্ধ দলে সংগঠিত করা হয় :
জেড ফোর্স : লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউর রহমান ছিলেন এ বাহিনীর কমান্ডার। ১৯৭১ সালের ৭ জুলাই ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ম, ৩য় ও ৮ম ব্যাটালিয়ন নিয়ে এ ব্রিগেড গঠিত হয়। ময়মনসিংহের বিপরীতে তুরা পাহাড়ের পাদদেশে জেড ফোর্স গড়ে তোলা হয়।
কে ফোর্স : লেফটেন্যান্ট কর্নেল খালেদ মোশাররফ ছিলেন এ বাহিনীর কমান্ডার। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৪র্থ, ৯ম ও ১০ম ব্যাটালিয়ন নিয়ে আগরতলায় এ ব্রিগেড গঠিত হয়।
এস ফোর্স : মেজর কেএম শফিউল্লাহ ছিলেন এ ফোর্সের কমান্ডার। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২য় ও ১১তম ব্যাটালিয়ন নিয়ে হেজামারায় ব্রিগেড গঠিত হয়।
পাকিস্তান নৌবাহিনীর অনেক বাঙালি নাবিক ও অফিসার তাদের ঘাঁটি ছেড়ে একটি উদীয়মান বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠন করেন। প্রাথমিকভাবে দুটি জাহাজ বিএনএস পদ্মা এবং বিএনএস পলাশ এবং ৪৫ জন নৌসেনা সদস্য ছিল। তারা দখলদার বাহিনীর জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ এবং রেশন সরবরাহে বাধা সৃষ্টি করে। নৌ কমান্ডোদের এ অভিযান চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে দখলদার বাহিনীর জন্য অত্যন্ত মারাত্মক করে তোলে।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী (বিএএফ) গঠনের আনুষ্ঠানিক তারিখ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ৮ অক্টোবর অস্থায়ী সরকার কর্তৃক চালু করা হয়। যুদ্ধের আগে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত সব বাঙালি বংশোদ্ভূত অফিসার এবং বিমানসেনাদের নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ বাহিনীর এগারোটি সেক্টরের মধ্যে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর, কেন্দ্রীয় সেক্টর-সেক্টর ১১ একজন বিএএফ অফিসারের অধীনে ছিল, যার মধ্যে সেক্টর ৬ ছিল। বিএএফ ডিমাপুরের একটি পরিত্যক্ত বিমানঘাঁটি থেকে তাদের কার্যক্রম শুরু করে।
মিত্রবাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে পরিচালিত এ যৌথ অভিযান যুদ্ধের ফলাফলকে ত্বরান্বিত করে, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকালীন চলমান অন্যান্য যুদ্ধের জন্য নতুন মাইলফলক হিসাবে বিবেচিত। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অবদানকে সাধারণ জনতার আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত করে রাখতে এবং ২১ নভেম্বরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সমুন্নত রাখতে ’৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে সম্মিলিতভাবে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর আগে ২৫ মার্চ সেনা, ১০ ডিসেম্বর নৌ এবং ২৮ সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী দিবস আলাদা আলাদাভাবে পালন করা হতো।
১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর, মুক্তিযুদ্ধের প্রায় নয় মাস পর, তিনটি বাহিনীই একযোগে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে, দিনটিকে সশস্ত্র বাহিনী দিবস হিসাবে চিহ্নিত করে। এ বাহিনীর যোগদানের ফলে প্রতিদিন সীমান্তের বিশাল এলাকা মুক্ত হতে থাকে। এর ফলে বাংলাদেশ বাহিনী কয়েক দিনের মধ্যেই যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সশস্ত্র বাহিনী দিবস