নিষ্ঠুর হাসিনার মৃত্যুদণ্ড

যুগান্তর ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী প্রকাশিত: ১৯ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৯

জুলাই গণ-আন্দোলন চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১-এ দায়েরকৃত মামলার রায়ে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের সমুদয় সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্য একটি মামলায় শেখ হাসিনাকে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মামলার অপর অভিযুক্ত সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক রাজসাক্ষী চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান দমনের নামে মানবতাবিরোধী অপরাধ করার অভিযোগে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার এটাই প্রথম রায়।


২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে অন্ধকার যুগের সূচনা করেছিলেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় একক ব্যক্তির শাসন কায়েম করা হয়। শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে দলীয়করণ ও আত্মীয়করণের মাধ্যমে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। মানুষের সব মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। বাকস্বাধীনতা, স্বাধীন চিন্তার অধিকার, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার অধিকার হরণ করা হয়। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়ে ব্যাপক লুটপাটের মাধ্যমে সামাজিক বৈষম্য তীব্রতর করা হয়েছিল। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কেউ সরকারের কাজের প্রতিবাদ জানালে তাকে গুম-খুনের শিকার হতে হয়। এভাবে গণতন্ত্রের কবর রচনা করা হয়। নির্বাচন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। সরকারপ্রধানের পরিবারের সদস্য এবং আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক নেতারা দেশের সম্পদ লুট করে দেশে-বিদেশ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনোই এভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট করা হয়নি। শেখ হাসিনা তার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশে যে নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করেছিলেন, তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। একজন বিকৃত মানসিকতার মহিলা যে কতটা হীনমন্য ও পরশ্রীকাতর হতে পারেন, শেখ হাসিনা তা দেখিয়ে দিয়েছেন। এর আগেও বাংলাদেশে কেউ কেউ অপশাসন ও স্বৈরশাসন কায়েম করেছিলেন; কিন্তু শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে সবাইকে অতিক্রম করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে শেখ হাসিনার শাসনামল জঘন্যতম নিষ্ঠুর শাসনের দৃষ্টান্ত হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে শেখ হাসিনার নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হেলিকপ্টার থেকে নিরীহ জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করেছে। একজন প্রধানমন্ত্রী তার নিজ দেশের মানুষকে এভাবে হত্যা করতে পারেন, তা কেউ ভাবতে পারেনি। তিনি তার শাসনামলে প্রমাণ করেছেন, একজন মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে।


কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা মনে করেন ক্ষমতা চিরস্থায়ী ব্যাপার। শেখ হাসিনা দেশকে তার নিজস্ব সম্পদ বিবেচনা করতেন। তিনি আজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকার স্বপ্ন দেখতেন। সেভাবেই প্রশাসন সাজিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা মনে রাখেননি। ইতিহাস অত্যাচারী শাসককে কখনোই ক্ষমা করে না। অত্যাচারী শাসকের পরিণতি কতটা নির্মম হতে পারে, ইতিহাসে তার প্রচুর প্রমাণ রয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম শিক্ষা হচ্ছে, ‘ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না।’


শেখ হাসিনার আমলে গণতন্ত্রহীনতায় মানুষ ছিল সব দিক থেকেই অসহায়। তথাকথিত উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট করাই ছিল শেখ হাসিনা সরকারের মূল লক্ষ্য। তিনি এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, তার পিয়ন নাকি ৪০০ কোটি টাকার মালিক। তিনি হেলিকপ্টার ছাড়া চলেন না। এ থেকে বোঝা যায়, শেখ হাসিনার শাসনামল কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। বিদেশ থেকে ঋণ এনে সেই অর্থ দিয়ে উন্নয়নের নামে চলত ব্যাপক লুটপাট। তারা এক সময় বলার চেষ্টা করেছিলেন, আমরা উন্নয়ন চাই নাকি গণতন্ত্র চাই। তাদের মতে, উন্নয়নের স্বার্থে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দেওয়া যেতে পারে। আওয়ামী লীগ সব সময়ই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলত। যেন তারাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সোল এজেন্ট। কিন্তু আওয়ামী লীগের হাতেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাধীনতার মূল চেতনা বা উদ্দেশ্য ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই গণতন্ত্র বিপর্যস্ত এবং অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়েছে। বেড়েছে মানুষে মানুষে বৈষম্য; অঞ্চলে অঞ্চলে বৈষম্য। শেখ হাসিনার সমর্থনপুষ্ট একটি শক্তিশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী দেশের ব্যাংকিং সেক্টরকে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করেছিল। তাদের লুটে নেওয়া অর্থের একটি ভাগ শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্যরা পেতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। শেখ পরিবার দেশের ওপর সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছিল। জাতি তাদের শোষণ থেকে মুক্তির জন্য রাস্তা খুঁজছিল।


শেখ হাসিনা তার অবৈধ শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য এমন কোনো কাজ নেই যা করেননি। গত বছর জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে দেড় হাজার মানুষকে হত্যা এবং ৩০ হাজার মানুষকে আহত করা হয়। মাত্র এক মাসের আন্দোলন চলাকালে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে মোট ৫টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এগুলো হচ্ছে : উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান, হেলিকপ্টার, ড্রোন ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের দমন করা, রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে হত্যা করা, রাজধানীর চানখাঁরপুলে আন্দোলনরত ৬ জনকে গুলি করে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ৬ জনকে হত্যা করে পুড়িয়ে মারা। প্রতিটি অভিযোগই প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। যেহেতু মামলার দুই আসামি শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ভারতে পলাতক রয়েছেন, তাই তারা আপিল করার সুযোগ পাবেন না। তারা যদি দেশে এসে আত্মসমর্পণ করেন তাহলেই আপিল করার সুযোগ পাবেন।


শেখ হাসিনা ইতিহাসের নিষ্ঠুর পরিণতির কথা ভুলে গেলেও আমরা তা ভুলিনি। এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা ইতিহাসের অমোঘ পরিণতি ভোগ করতে চলেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে, স্বৈরাচারী শাসক যতই ক্ষমতাবান, অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর হোক না কেন, তার পতন অনিবার্য।


শেখ হাসিনার নির্মম ও নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শাসনে দেশের মানুষ ছিল অতিষ্ঠ। কথায় বলে, ‘রাত যত গভীর হয়, প্রভাতের সূর্য ততই নিকটবর্তী হয়।’ শেখ হাসিনা সরকারের নির্মম নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ এক সময় রাস্তায় নেমে আসে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে দেয় ছাত্ররা এবং রাজনৈতিক দলগুলো একপর্যায়ে তাতে যুক্ত হয়। কাজেই চব্বিশের আন্দোলন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে আগের যে কোনো আন্দোলনের চেয়ে ভিন্নতর ছিল। ইতঃপূর্বে বাংলাদেশের আর কোনো প্রধানমন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়নি। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পরিণতি যে এতটা ভয়াবহ হবে, তা আগেই অনুমান করা গিয়েছিল। শুধু বুঝতে পারেননি শেখ হাসিনা নিজে। শেখ হাসিনা ক্ষমতার মোহে এতটাই অন্ধ ছিলেন যে, তিনি মানুষের হৃদয়ে জমে থাকা ক্ষোভের বিষয়টি অনুধাবন করতে পারেননি। একদল চাটুকার তাকে সব সময়ই ঘিরে থাকত। শেষ পর্যন্ত তাকে অদৃষ্টের দেওয়া চূড়ান্ত শাস্তি পেতে হলো। প্রচণ্ড প্রতাপশালী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের আদেশের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। পালিয়ে গিয়েও শেখ হাসিনার রক্ষা হয়নি। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের পরিবারের দাবি হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করা হোক। তাহলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও