একটু উষ্ণতার জন্য
ষড়ঋতুর এই দেশে একেকটি ঋতু একেক রূপ রং নিয়ে হাজির হয়। অভ্যস্ত মানুষজন প্রকৃতির এই পালাবদলের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেন খুব সহজেই। যদিও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ পরিস্থিতির কারণে ঋতুর পালাক্রম রক্ষা হচ্ছে না। অর্থাৎ শীতকালে গরম বা গরমকালে শীত পড়ছে। বর্ষায় বৃষ্টির দেখা নেই। আগে যেমন মুষলধারে বর্ষার বৃষ্টি সবকিছুকে ছাপিয়ে-ভাসিয়ে নিয়ে যেত এখন সেটা নেই। এরপরও প্রকৃতির কিছু নিয়ম তো অলঙ্ঘনীয়।
শীতকাল, প্রকৃতির এক শান্ত অথচ শক্তিশালী রূপ। শরতের স্নিগ্ধতা পেরিয়ে হেমন্তের হাত ধরে যখন শীতের আগমন ঘটে, তখন প্রকৃতিতে এক ভিন্ন আমেজ তৈরি হয়। এই সময়ে আকাশ থাকে ঝকঝকে নীল, বাতাস হয়ে ওঠে হিমেল এবং চারপাশের পরিবেশ ধারণ করে এক মায়াবী রূপ। হেমন্তের ফসল কাটা শেষ হয়। কাটা ধানের নাড়াপুচ্ছে জমতে থাকে শিশির।
শীতের সকাল শুরু হয় কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে। ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু মুক্তোর মতো দ্যুতি ছড়ায়। সূর্যের সোনালি আলো যখন সেই কুয়াশা ভেদ করে উঁকি দেয়, তখন প্রকৃতি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। এই দৃশ্য শহুরে কোলাহল থেকে অনেক দূরে, গ্রামের মেঠো পথে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করা যায়।
শীতকাল মানেই পিঠা-পুলি আর খেজুরের রস খাওয়ার ধুম। সন্ধ্যা নামতেই প্রতি বাড়িতে চলে পিঠা তৈরির উৎসব। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটি সাপটা, নকশি পিঠা- এই সব ঐতিহ্যবাহী খাবার শীতের রাতগুলোকে আরও মধুর করে তোলে। টাটকা খেজুরের রস আর গুড়ের স্বাদ এই সময়ে বাঙালির অন্যতম প্রিয় আকর্ষণ। তবে রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে হলে কাঁচা খেজুরের রস না খাওয়াই ভালো। কেননা নিপাহ ভাইরাস সাধারণত বাদুরের মাধ্যমে ছড়ায়। তারা যখন কাঁচা খেজুরের রস পান করে, তখন তাদের লালা বা মল রসে মিশে যায়, ফলে রসটি ভাইরাসে দূষিত হয়।
প্রকৃতির দিক থেকে শীতকালে অনেক গাছের পাতা ঝরে যায়, বিশেষ করে শুষ্ক অঞ্চলে। মনে হয় প্রকৃতি বুঝি বিশ্রাম নিচ্ছে। তবে এই আপাত শুষ্কতা সত্ত্বেও, অনেক রঙিন ফুল যেমন গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা এই ঋতুতেই ফোটে এবং বাগানগুলোকে উজ্জ্বল করে তোলে।
শীতের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো এই সময়ে মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন। গরম কাপড়, শাল, মাফলার হয়ে ওঠে নিত্যসঙ্গী। সন্ধ্যায় বা রাতে আগুনের পাশে বসে গল্প করা বা রোদ পোহানো হয়ে ওঠে আরামদায়ক। তবে, শীতকাল সবার জন্য আনন্দদায়ক নয়। ছিন্নমূল ও দরিদ্র মানুষেরা শীতের তীব্রতায় ভোগেন। তাদের কষ্ট লাঘবে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত। পুরানো বা নতুন গরম কাপড় বিতরণের মাধ্যমে তাদের পাশে দাঁড়ালে শীতের প্রকৃত মানবতা ফুটে উঠবে।
শীতকালকে নানাভাবে উপভোগ্য করে তোলা সম্ভব। প্রকৃতির এই শান্ত সময়ে কিছু বিশেষ কাজ ও আয়োজনের মাধ্যমে শীতকে আরও আনন্দময় করে তোলা যায়।
শীতের প্রধান আকর্ষণ হলো টাটকা খেজুরের রস এবং নানা ধরনের পিঠা। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে নিয়ে ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটিসাপটা, পুলি পিঠা খাওয়ার আসর বসাতে পারেন। এই ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো শীতের সন্ধ্যাগুলোকে দারুণ উপভোগ্য করে তোলে।
শীতকাল ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময়। এই সময়ে আবহাওয়া থাকে মনোরম এবং গরমের ক্লান্তি থাকে না। পরিবারের সাথে কোনো সুন্দর জায়গায় পিকনিক করতে পারেন বা কাছাকাছি কোনো দর্শনীয় স্থানে ঘুরে আসতে পারেন। পাহাড়, সমুদ্র বা গ্রামের শান্ত পরিবেশ এই সময়ে দারুণ উপভোগ্য।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শীতকাল
- বাংলাদেশের পিঠা-পুলি
- উষ্ণতা