বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তের প্রধান বিপদ

যুগান্তর ড. মাহবুব উল্লাহ প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১০:৩৩

আওয়ামী দানবরা আবারও ফিরে আসার অপতৎপরতায় মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে প্রতীয়মান হয়। তারা চায় অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকারের পতন। ইউনূস সরকার নির্বাচিত না হওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবেই এর অন্তর্নিহিত কিছু দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে দেশে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও জননিরাপত্তা বিধানে এই সরকার খুব একটা সাফল্য দেখাতে পারেনি। এখনো এই সরকারের পেছনে জনগণের একটি বড় অংশের আস্থা রয়েছে। এই সরকারের নৈতিক শক্তি ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান। এই অভ্যুত্থান সাধারণ কোনো অভ্যুত্থান নয়, প্রায় ২ হাজার পুরুষ, নারী, যুবক, কিশোর-কিশোরী ও শিশু আত্মাহুতি দিয়েছে। এদেরকে নির্বিচারে হত্যা করতে শেখ হাসিনার বর্বর সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাত কাঁপেনি। যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তারা কেউ মৃত্যুভয়ে ভীত ছিলেন না। পুলিশের এক কর্মকর্তাই আওয়ামী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছে, স্যার একটা মারলে আরেকটা এগিয়ে আসে। মানুষের মনে যখন এমন সাহস জাগ্রত হয়, তখন সে হয়ে ওঠে মৃত্যুঞ্জয়ী।


আওয়ামী খুনিরা তাদের হত্যাকাণ্ড জায়েজ করতে অদ্ভুত এক গল্প ফেঁদেছে। সেই গল্প অনুযায়ী আওয়ামীরা প্রচার করেছে, বিক্ষোভকারীদের এক ধরনের নেশাসংবলিত পানি পান করিয়েছে আন্দোলনের হোতারা। ফলে নেশাগ্রস্ত হয়ে বিক্ষোভকারীরা বুলেট মোকাবিলা করতেও পিছপা হয়নি। আওয়ামী খুনিরা আরও বলতে চায়, একটি মেটিকুলাস প্ল্যানের মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থানটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জনগণের আপসহীন অভ্যুত্থানের মুখে পরাজিত হয়ে এমন আষাঢ়ে গল্প ফাদাই আওয়ামী খুনিদের আত্মপ্রবঞ্চনার শেষ ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে।


গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের পাশাপাশি শত-সহস্র আহত হয়েছে। কেউ চোখ হারিয়েছে, কেউ পা হারিয়েছে, কেউ চিরদিনের জন্য বিকলাঙ্গ হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ হাসপাতালে কিছুদিন বা কয়েক মাস চিকিৎসাধীন থাকার পর মৃত্যুবরণ করেছে। এভাবে অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। অতীতের অনেক গণ-অভ্যুত্থানের মতো নয়, ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে যারা অংশগ্রহণ করেছে, তারা মৃত্যু অবধারিত জেনেই অভ্যুত্থানে শামিল হয়েছে। অনেক শিশু-কিশোরের পিতা-মাতারা তাদেরকে ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। এজন্যই বোধহয় কার্ল মার্কস্ বলেছিলেন, When ideas grip, the minds of the masses can become a great material force. ২৪-এর অভ্যুত্থানে এমনটিই ঘটেছিল। অভ্যুত্থানটি আরও কিছুদিন চলমান থাকলে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র তার সামরিক বাহিনী, আমলাতন্ত্র, পুলিশ বাহিনী, গোয়েন্দা বাহিনী, আইন-আদালত ও কারাগার নিয়ে ধসে পড়ত। প্রয়োজন হতো পুরোনো রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থলে নতুন করে গড়ে তোলা রাষ্ট্রযন্ত্র। কিন্তু অভ্যুত্থানটি তত দূর গড়ায়নি। তাই হতে পারেনি একটি পরিপূর্ণ বিপ্লব। এটা সম্ভব হয়েছে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সুচিন্তা, সুমতি ও বিবেক বোধ জাগ্রত হওয়ায়। কারফিউ দিয়ে শেখ হাসিনা চেয়েছিলেন সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে লাগামহীন নির্দয় এক গণহত্যা চালিয়ে যেতে। রক্তবন্যায় জনতার অভ্যুত্থানকে ভাসিয়ে দিতে। কিন্তু সেনাবাহিনী ৫ আগস্ট ২০২৪ সাফ জানিয়ে দিয়েছিল, জনতার ওপর তারা গুলি চালাবে না। আর এক ফোঁটা রক্ত ঝরতে দেওয়া হবে না। অতীতেও দেখা গেছে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ক্রুশিয়াল মোমেন্টে জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়নি। এটা তাদের অন্তর্গত এক সৎচিন্তা। ২০২৪-এর আগস্টে সেনাবাহিনীর সিদ্ধান্তের ফলেই পুরোনো রাষ্ট্রযন্ত্র রক্ষা পেয়ে যায়। অভ্যুত্থানে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার মহাসহায়ক। পুলিশ এবং র‌্যাব ফ্যাসিবাদী সরকারকে রক্ষা করতে গিয়ে চরম নির্দয়তার আশ্রয় নিয়েছিল। এ কারণে দেখা গেছে, জনতার রুদ্ররোষের ভয়ে পুলিশ বাহিনী থানা-ফাঁড়ি ও দপ্তর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। এটাই ছিল পুরোনো রাষ্ট্রযন্ত্র ভেঙে পড়ার একটি নিদর্শন। হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের অত্যাচার-উৎপীড়ন তার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনজুড়েই অব্যাহত ছিল। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, খুন, আয়নাঘরে গোপনভাবে অন্তরীণ, মামলা-হামলা এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের বিষয়-সম্পত্তি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস হয়ে পড়েছিল নিত্যকার ঘটনা। সারা দেশ পরিণত হয়েছিল এক দুর্বিষহ কারাগারে। ফ্যাসিস্ট শাসকরা ভেবেছিল, তারা চিরদিন অত্যাচার-অবিচার করে জনগণকে শৃঙ্খলিত করে রাখবে। কিন্তু জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিশাল বিস্ফোরণে পরিণত হয়েছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে। এই অভ্যুত্থানের উত্তাল জোয়ারে ভেসে যায় অত্যাচারের তখত্-তাউস্। এমনই এক অভ্যুত্থানের নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়েই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের দায়িত্ব নিয়েছে।


এই সরকারকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া সহজ নয়। তবে কিছু বিশৃঙ্খলা, কিছু নৈরাজ্য, কিছু সহিংসতা এবং কিছু নাশকতা সৃষ্টি করা আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। তাদের হাতে রয়েছে রাষ্ট্র থেকে লুণ্ঠিত হাজার হাজার কোটি টাকা। নেতারা ভারতে পালিয়ে গেলেও তাদের ঠ্যাঙ্গারে বাহিনীর সদস্যরা এখনো অনেকে দেশের ভেতরে রয়েছে। এদেরকে টাকা দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টিতে মাঠে নামানো অসম্ভব কিছু নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এরা মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় মেতে উঠেছে। কলকাতা ও দিল্লিতে দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। অতি সম্প্রতি তারা ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশে শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ও রাজধানীতে আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা ঝটিকা মিছিল করছে। কখনো কখনো এসব মিছিলকারী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হচ্ছে অথবা জনগণ তাদের পাকড়াও করে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছে। ঢাকা মহানগরীতে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্তভাবে বাসে আগুন দেওয়া হচ্ছে। এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, দেশ ও ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হলেও আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় পুনঃপ্রত্যাবর্তনে হেন অপকর্ম নেই, যা তারা করবে না।


দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ইউনূস সরকারের দুর্বলতার উৎস হলো পুলিশ বাহিনী এখন পর্যন্ত পরিপূর্ণভাবে সংগঠিত হয়ে উঠতে না পারা। তবে এই সরকার গণহত্যাকারীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা সন্তোষজনক। এই বিচারকার্য তার যৌক্তিক পরিণতিতে নেওয়া সম্ভব হলে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে।


দেশের এই পরিস্থিতিতে জুলাই অভ্যুত্থানের ফলাফল ধরে রাখার জন্য কতটা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা নিরর্থক কিছু হবে না। জুলাই অভ্যুত্থানের পরপর দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাতে চিড় ধরতে শুরু করেছে। ভয় হয়, কখন এই চিড় বড় আকারের ফাটলে পরিণত হয়। যে কোনো মূল্যে ঐক্যের চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোট নিয়ে যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে, তার নিরসন না হলে, মহাসংকট তৈরি হবে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও