তিস্তা মহাপরিকল্পনার যে সাতটি প্রশ্নের উত্তর জানা দরকার
ভারত কর্তৃক তিস্তাপ্রবাহের ওপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপন ও প্রবাহ অপসারণ এবং দেশের ভেতরে অনুসৃত বিভিন্ন অনুপযোগী নীতি অনুসরণের ফলে তিস্তা নদী এক গভীর সংকটে নিপতিত। শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব, বর্ষাকালের বন্যা, অসময়ে হড়কা বন্যা, প্রকট নদীভাঙন ইত্যাদি সমস্যা দ্বারা তিস্তাপারের প্রায় দুই কোটি মানুষের জীবন জর্জরিত। তিস্তা সমস্যার আশু সমাধান অত্যন্ত জরুরি।
তিস্তা সংকট সমাধানের দাবিতে ২০০৭ সালে ‘তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন’ গঠিত হয় এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) সহযোগিতায় প্রায় ২০ বছর ধরে এই সংকট সমাধানের দাবিতে নিরলস প্রয়াস পরিচালিত হচ্ছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে তিস্তা সংকটের সুরাহা করায় অপারগ হয়ে ২০১৬ সালে চীনের ‘পাওয়ারচায়না’ নামের কোম্পানি কর্তৃক প্রস্তাবিত একটি পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হয়। তখন ভারত নিজেই এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
এ বিষয়টি নিয়ে সেই সরকার দ্বিধায় পড়ে এবং তাতে চীন রুষ্ট হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার চীনের সহযোগিতায় পাওয়ারচায়না প্রকল্প বাস্তবায়নে উৎসাহী হয়েছে এবং সেই ধারায় অগ্রসর হচ্ছে।
পাওয়ারচায়না প্রকল্পের মাধ্যমে যদি তিস্তা সংকটের সমাধান অর্জিত হয়, তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে আনন্দের বিষয় হবে; কিন্তু চীনের দ্বারা প্রস্তাবিত এবং বাস্তবায়িত হলেই যে একটি প্রকল্প সফল হবে, তার নিশ্চয়তা নেই।
উন্নয়নশীল বিশ্বের অভিজ্ঞতা দেখায় যে চীনের সহযোগিতায় নির্মিত বহু প্রকল্প অসফলও হয়েছে। বাংলাদেশেও এর উদাহরণ রয়েছে। যেমন চীনের সহযোগিতায় নির্মিত পদ্মা সেতু একটি সফল প্রকল্প।
কিন্তু চীনের সহযোগিতায় নির্মিত কয়লাভিত্তিক অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার শেষ পর্যন্ত কয়লাভিত্তিক ১১টি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল, যার মধ্যে ৬টি সম্পূর্ণ বাতিল এবং বাকি ৫টিকে কয়লা থেকে গ্যাসে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলাদেশের নদ–নদীর পরিস্থিতি চীনের নদ–নদী থেকে খুবই ভিন্ন। ফলে বাঁধ নির্মাণে চীনের বিপুল প্রযুক্তিগত সামর্থ্য থাকলেও বাংলাদেশের নদ–নদী ব্যবস্থাপনায় তাদের পারদর্শিতা যে উপযোগী হবে, তার নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা দেখায় যে অতীতে নদী ব্যবস্থাপনায় ওলন্দাজদের (ডাচ) চিন্তাভাবনা ও কারিগরি পরামর্শ অনুসরণ করে বাংলাদেশ বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। (এ বিষয়ে লেখকের ‘প্রথম আলো’য় এই বছরের ৮ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনায় চীনা সহায়তার ভালো–মন্দ’ শীর্ষক নিবন্ধ দেখুন)
সুতরাং চীনের সহযোগিতায় নির্মিতব্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা ঠিক হবে কি না, তা বাস্তবায়নের আগেই সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন।
কোনো প্রকল্প মূল্যায়নের জন্য প্রয়োজন সেই প্রকল্প-সংক্রান্ত তথ্য। দুঃখজনক যে বিগত সরকার তিস্তাবিষয়ক পাওয়ারচায়নার প্রকল্প নিয়ে অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করেছিল এবং এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা (ফিজিবিলিটি স্টাডি) প্রকাশ করেনি।
এমনকি এই প্রকল্পের পিডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্পের প্রাথমিক প্রস্তাবনা) প্রকাশ করেনি; কিন্তু জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে বাপা ও বেন এই প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের বিশেষ চেষ্টা করে এবং প্রকল্পের পিডিপিপি এবং আরও কিছু তথ্য পায়।
এ ছাড়া পাওয়ারচায়না তিস্তাবিষয়ক প্রকল্প নিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী প্রচার করে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে বাপা-বেনের গবেষকেরা এই প্রকল্প পরিবীক্ষণ করেন এবং তার ভিত্তিতে ২০২০-২৩ মেয়াদকালে প্রকাশিত একাধিক পুস্তক ও প্রবন্ধে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- তিস্তা পানি চুক্তি