নারীর সম্মানহানি ও সাইবার বুলিংয়ের পেছনের রাজনীতি

প্রথম আলো উম্মে ওয়ারা প্রকাশিত: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১৩:৩৪

বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই আগের বছরের চেয়ে সহিংসতার শিকার হওয়া নারীর সংখ্যা মনে হয় বাড়তে থাকে।


গত ১৩ অক্টোবরে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও বাংলাদেশে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের জরিপ অনুযায়ী, প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন নারী (৭৬ শতাংশ) তাঁদের জীবনে অন্তত একবার জীবনসঙ্গী বা স্বামী কর্তৃক সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে শারীরিক, যৌন, মানসিক ও অর্থনৈতিক সহিংসতা।


এর প্রায় অর্ধেক নারী (৪৯ শতাংশ) গত এক বছরে এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই জরিপে নন-পার্টনার (সঙ্গী নয় এমন ব্যক্তি ও সত্তা) দ্বারা সহিংসতার বিষয়টিও তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ নারী প্রযুক্তির সহায়তায় সংঘটিত নির্দিষ্ট কিছু জেন্ডারভিত্তিক (লৈঙ্গিক) সহিংসতার (টেকনোলজি-ফ্যাসিলিয়েটেড জেন্ডার-বেজড ভায়োলেন্স) শিকার হয়েছেন, যা যৌন ব্ল্যাকমেল, ছবি নিয়ে অপব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত।


নির্দ্বিধায় বলা যায়, সমাজের যেকোনো স্তরের, যেকোনো পেশার নারীই বাস্তবে বা অনলাইনে সংঘটিত এ ধরনের জেন্ডারভিত্তিক আক্রমণের শিকার হয়ে থাকেন। সাম্প্রতিক কালে একজন নারী গণমাধ্যমকর্মীর আত্মহত্যার ঘটনায় একই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘বাজে আচরণের’ মতো গুরুতর অভিযোগ আনেন তাঁদেরই সহকর্মী। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষকও সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন কিছুদিন ধরে।


শারীরিকভাবে আঘাত না করেও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নারীদের সম্মানহানি ও বুলিং করার এই প্রবণতাকে বিক্ষিপ্ত কোনো ঘটনা হিসেবে দেখলে চলবে না; বরং এর পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে বুঝতে হবে। ফরাসি নারীবাদী ও সমাজতাত্ত্বিক সিমোন দ্য বোভোয়ারের ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত দ্য সেকেন্ড সেক্স বইটি আধুনিক নারীবাদী চিন্তার অন্যতম মৌলিক গ্রন্থ, যা নারী-পুরুষ সম্পর্কের সামাজিক, ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ভিত্তি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানায়।


বইটির কেন্দ্রীয় তত্ত্ব হলো ‘কেউ নারী হয়ে জন্মায় না, বরং নারী হয়ে ওঠেন।’ অর্থাৎ নারী-পুরুষের পার্থক্য কেবল জৈবিক নয়, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের দ্বারা সেটি নির্মিত হয়ে থাকে। সব জায়গায় পুরুষকে ‘মানুষ’ বা ‘সর্বজনীন সত্তা’ হিসেবে দেখা হয়েছে; আর নারীকে দেখা হয়েছে সেই পুরুষের তুলনায় ‘অন্য’, ‘অধীন’ বা ‘বিচ্যুত’ সত্তা হিসেবে। তিনি লিখেছেন: ‘হি ইজ দ্য সাবজেক্ট, হি ইজ দ্য অ্যাবসলিউট—শি ইজ দ্য আদার’ (পুরুষ হলেন কর্তা, পুরুষ হলেন পরম—নারী হলেন অপর)। এর কারণ হলো, শৈশব থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় কীভাবে ‘নারীসুলভ’ হতে হয়—কোমলতা, আনুগত্য ও সংবেদনশীলতার মাধ্যমে।


অপর দিকে ছেলেদের শেখানো হয় কীভাবে ‘পুরুষালি’ হতে হয় রাগ, আত্মনির্ভরতা ও কর্তৃত্বশীলতার মাধ্যমে। অথচ একজন নারীর যেমন স্বাবলম্বী হওয়া প্রয়োজন, একজন পুরুষের তেমনি সংবেদনশীল হওয়া ততটাই জরুরি। কিন্তু তার পরিবর্তে ‘টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি’ বা ‘বিষাক্ত ব্যাটাগিরি’র দুষ্ট চক্রে যেমন পুরুষদের আবদ্ধ করে ফেলে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ, তেমনি নারীদের জীবনের ব্রতও হয়ে ওঠে ‘অন্যের জন্য বাঁচা’।


এই অসম সামাজিক প্রক্রিয়ায় পুরুষ নিজেকে ‘সাবজেক্ট’ (কর্তাসত্তা) হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, আর নারীকে করে ‘অবজেক্ট’ (অধীন সত্তা) হিসেবে। এই সামাজিকীকরণের ফলে মেয়েরা নিজেদের অস্তিত্বকে পুরুষের দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতে শেখেন, যা তাঁদের আত্মচেতনার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এ প্রসঙ্গে বোভোয়ারের মূল তত্ত্ব হলো ‘অস্তিত্ববাদী স্বাধীনতা’, অর্থাৎ প্রত্যেক মানুষ নিজের জীবনের অর্থ নিজেই নির্ধারণ করবে এবং নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজের অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করবে, যা মূলত অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, শিক্ষা ও সামাজিক সমান সুযোগ ছাড়া অসম্ভব।


সিমোন দ্য বোভোয়ার যেমন সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারী-পুরুষের জৈবিক পার্থক্যকে ব্যবহার করে নারীকে গৃহে আবদ্ধ করে রাখার কৌশলের কথা বলেছেন, পরবর্তী সময় ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ–বিশ্লেষক সিলভিয়া ওয়ালবিও তাঁর থিওরাইজিং প্যাটরিয়ার্কি (১৯৯০) বইয়ে পিতৃতন্ত্রকে (প্যাটরিয়ার্কি) কেবল নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য নয়; বরং একটি জটিল সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে দেখিয়েছেন, যা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্মিত ও কার্যকর হয়ে থাকে। তিনি বলেন, নারীর ওপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণ একক নয়; বরং এটি ছয়টি পরস্পর-সংযুক্ত কাঠামো বা সিক্স প্যাটরিয়ার্কাল স্ট্রাকচারসের মাধ্যমে বজায় থাকে, যা পিতৃতন্ত্রকে অর্থনীতি, পরিবার, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত একটি বহুস্তরীয় সামাজিক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করে থাকে। ছয়টি কাঠামোর মধ্যে রাষ্ট্র ও সংস্কৃতি কীভাবে পিতৃতান্ত্রিকতাকে ধারণ ও পুনরুৎপাদন করে, সেটি ব্যাখ্যা করা যাক। 


ওয়ালবি যুক্তি দেন, রাষ্ট্রের আইন, নীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোও পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধে গঠিত। অর্থাৎ এগুলো দেখতে ‘সাধারণ’ বা ‘সবার জন্য’ মনে হলেও বাস্তবে পিতৃতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখার বা নারীদের অধীন অবস্থায় রাখার প্রয়াস চলমান থাকে। যেমন গত ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ পুলিশের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে এক তরুণীকে পোশাক নিয়ে হেনস্তা করা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে। একই সঙ্গে পোস্টটিতে ‘কারও পোশাক দৃষ্টিকটু লাগলে যথাস্থানে অভিযোগ জানাতে’ আহ্বান জানানো হয়েছে। এমনকি কিছুদিন আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে উত্ত্যক্তকারী হিসেবে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে থানায় ঢুকে যেভাবে ভিডিও–সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ও জামিন লাভের পর পুলিশের সামনেই তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে, সেটা রাষ্ট্রের জন্য চরম লজ্জার, আমাদের জন্য হতাশার।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও