অনৈক্যের কালোমেঘ ও ঐক্যের সন্ধান
গণভোটের দিন নির্ধারণ ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো কোনো সমঝোতা না হওয়ায় দুশ্চিন্তার-অনৈক্যের কালোমেঘ ঘন হচ্ছে। বিরোধ মেটাতে সরকারের পক্ষ থেকে সময় বেঁধে দেওয়া হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। উলটো বিরোধ আরও বেড়েছে এবং গণভোট ও জুলাই সনদ ইস্যুতে বিএনপি ও জামায়াত দৃশ্যত মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে; যা অনেকটা ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’র মতো। ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৌহার্দের বদলে ‘আলটিমেটাম’কবলিত। দলগুলো আলোচনার বদলে শক্তি প্রদর্শনের হুমকিও দিয়ে রেখেছে, যার মধ্যে রয়েছে মাঠ দখল রাখা ও নিজের দাবিতে অটল/অনড় থাকা।
গত সপ্তাহের শেষদিন, বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তার উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গণভোটের দিন নিয়ে দীর্ঘ সময় অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। এ সময় রাজনৈতিক দলগুলোর বর্তমান অবস্থান বিশ্লেষণ করে কয়েকজন উপদেষ্টা হতাশা প্রকাশ করেন। তারা বলেন, গণভোটের দিন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ঐক্যবদ্ধ কোনো সিদ্ধান্ত আশা করা যাচ্ছে না। তারপরও উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে রাজনৈতিক দলগুলোকে সমঝোতার আহ্বান জানানো হয়েছিল; কিন্তু সেই আহ্বানের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে দৃশ্যমান আলোচনা করতে দেখা যায়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার আশা প্রকাশ করেছে, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরাই একটা সিদ্ধান্তে আসবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে তাদের দাবির ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত নমনীয় কোনো অবস্থানের আভাস পাওয়া যায়নি এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতার ইঙ্গিতও দৃশ্যমান হয়নি। বরং দলগুলোর মধ্যে দূরত্ব ও তিক্ততার আলামত ক্রমেই সামনে আসছে।
রাজনৈতিক ইস্যুতে দলগুলোর দাবি ও বক্তব্য স্পষ্টতই পরস্পরবিরোধী। বিএনপি বলছে, সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট হতে দেওয়া হবে না। জামায়াত বলছে, নির্বাচনের আগে গণভোট দিতেই হবে। এজন্য ১১ তারিখ পর্যন্ত আলটিমেটাম দিয়ে বলেছে, না মানলে ঢাকার চিত্র ভিন্ন হবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘জুলাই সনদের যে পথে তারা এগোচ্ছেন-সেটি বাস্তবায়িত হবেই। জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করেই নির্বাচন হতে হবে।’ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এ সনদের আদেশ দিতে হবে বলেও দাবি করেন তিনি। অন্যদিকে, গণভোট আয়োজনের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি, রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ফোন করে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনার আহ্বান জানান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বুধবারই দলের স্থায়ী কমিটির মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত খুব পরিষ্কারভাবে আপনাদের জানিয়ে দিয়েছি। ওটাই আমাদের বক্তব্য।
দলগুলোর বিভেদের পরিস্থিতিতে আরেকটি আতঙ্কজনক তথ্য হলো, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে, নির্বাচনি মাঠ ততই উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। এ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হতে পারে আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে বা আরও প্রায় এক মাস পর। কিন্তু এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনানুষ্ঠানিক নির্বাচনি প্রচার শুরু হয়ে গেছে এবং নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সহিংসতায় ১১ জনের মতো নিহত হয়েছেন।
বাস্তবতা হলো, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টার পরও প্রাক-নির্বাচনি পরিবেশ এখনো নাজুক। রাজনৈতিক সহিংসতা, স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব এবং নিরাপত্তা বাহিনীর প্রতি অবিশ্বাস রয়ে গেছে। দলগুলোর মধ্যেও রয়েছে মতপার্থক্য। এসব কারণে জনগণের আস্থা ধরে রাখতে যোগাযোগ, রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের অংশীদারদের সঙ্গে সংলাপ অপরিহার্য বলে মনে করছে আইআরআই। এমন পরিস্থিতিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এমনই সুপারিশ করেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ ও মেয়াদ শেষ হলেও দেশে রাজনৈতিক ঐক্যের পরিসর বৃদ্ধি পায়নি, এটি এক কঠিন বাস্তবতা। বরং চলমান রাজনীতিতে ঐকমত্যের আলামত খুব কমই দেখা যাচ্ছে। বদলে রাজনীতিতে বইছে গরম হাওয়া। দেখা যাচ্ছে অসহিষ্ণুতা, অনৈক্য ও বিভেদের আলামত। এমনকি, শুরু হয়ে গেছে হুমকি ও উত্তেজনা। এতে ঐক্যের পাশাপাশি নির্বাচন, গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তার আশঙ্কাও করছেন অনেকেই। তবে, আশঙ্কার মধ্যেও দেশবাসী আশা করছেন, বিদ্যমান পারস্পরিক বিরোধের সংকুল ও স্পর্শকাতর পরিস্থিতিতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো দায়িত্বশীল আচরণ করবে। কোনো হঠকারিতা ও উত্তেজনার পথ সম্পূর্ণভাবে পরিহার করে শান্তি, শৃঙ্খলা ও সমঝোতার ধারাকে নির্বিঘ্ন রাখবে এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য, গণতান্ত্রিক উত্তরণ ও নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মতো আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে মুক্ত থাকবে।
এ কথাও মনে রাখতে হবে, দেশের ভেতরে সংকট বাড়লে বাইরে থেকেও সমস্যা বাড়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। যেমন, ভারতের দক্ষিণাঞ্চল থেকে প্রকাশিত ডেকান ক্রনিকলের এক রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় চোখ রেখে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরে একটি নতুন সামরিক ঘাঁটি বসিয়েছে ভারতের সেনাবাহিনী। ‘মিনিমাল টাইমফ্রেমে’র মধ্যে তা বসানো হয়েছে। প্রতিবেশী বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর নিরাপত্তা শক্তিশালী করতে আসামের ধুবরিতে একটি নতুন সামরিক স্টেশনও গড়ে তুলছে ভারত। এ হলো আশপাশের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। আমাদের দলকানা রাজনীতিবিদরা আশপাশের এসব বিপদ ও উদ্বেগের বিষয়ে আদৌ অবহিত কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন। এমন প্রশ্নও জাগে, ক্ষমতায় যাওয়া ছাড়া দেশের স্বার্থে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোর সচেতন কিনা। মনে হয় না। যদি দলগুলোর মধ্যে সচেতনতা ও অনুভূতি থাকত, তাহলে দেশের নিরাপত্তার বিষয়ে ও জাতীয় স্বার্থের ইস্যুতে সরকার ও অন্যান্য দলকে নিয়ে একত্রে বসে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারত। বাংলাদেশে এমন ইতিবাচক পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। বরং সদ্যসমাপ্ত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম আশার বদলে হতাশা এবং ঐক্যের বদলে অনৈক্যের ছাপ রেখেছে।
দলগুলোর মধ্যকার সুস্পষ্ট মতপার্থক্য মূলত ইগো রাজনীতির কুপ্রভাব। বড় দল, বড় নেতার মানসিকতায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেই দিবাস্বপ্নে মশগুল। অনেকের মধ্যে ক্ষমতায় চলে যাওয়ার মতো অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে। এসব মনোভাব ও কার্যক্রম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির ঘোরতর শত্রু এবং ফ্যাসিবাদী-একনায়কতন্ত্রী-স্বৈরতন্ত্রী হওয়ার বীজমন্ত্র। ফলে দেশে ফ্যাসিবাদমুক্ত সরকার হলেও যে ফ্যাসিবাদী মানসিকতামুক্ত রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা হলফ করে বলা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায়, গণভোটের দিন নির্ধারণ ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে। সংকট বা বিপদ শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বাইরে থেকেও বাড়ছে। তাই রাজনীতিতে ইগো সমস্যা, মতপার্থক্য ও দূরত্বের কারণে বিরাজমান বিভেদ অশনিসংকেতস্বরূপ এবং নানাবিধ বিপদ ও ঝুঁকির আগামবার্তাবিশেষ। রাজনৈতিক দলগুলো যদি আত্মস্বার্থের চোরাগলি থেকে জাতীয় স্বার্থের প্রসারিত রাজপথে না আসে, তাহলে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে চরম অচলাবস্থার উদ্ভব ঘটতে পারে।