জাল টাকা : অর্থনীতির এক ‘নীরব ঘাতক’
টাকা শুধু বিনিময়ের একটি মাধ্যম নয়, এটি একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও অর্থনীতির ভিত্তিমূল। কিন্তু যখন এই ভিত্তিমূলে আঘাত হানে ‘জাল টাকা’ নামক বিষফোঁড়া, তখন পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোতেই অস্থিরতা তৈরি হয়। জাল টাকা হলো প্রতারণার এক ভয়াল রূপ, যা সাধারণ মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে দুর্বল করে দেয়। সম্প্রতি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর অভিযানে কোটি কোটি টাকার জাল নোট উদ্ধার এবং বেশ কয়েকটি চক্রের গ্রেফতারের ঘটনা প্রমাণ করে, এ সমস্যাটি এখনো আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
জাল টাকা মূলত অর্থনীতির জন্য এক ‘নীরব ঘাতক’। যখন বাজারে জালনোটের সরবরাহ বাড়ে, তখন টাকার প্রকৃত মূল্য কমে যায়। ফলে মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয় এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। এছাড়া জালনোটের বিস্তারের ফলে মানুষ নগদ লেনদেনে আস্থা হারায়, যা স্বাভাবিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম ব্যাহত করে।
আগে জাল টাকা তৈরি হতো নিম্নমানের কাগজে, যা সহজেই চেনা যেত। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির অপব্যবহারে এখন এতটাই নিখুঁতভাবে জালনোট তৈরি হচ্ছে যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে খালি চোখে তা শনাক্ত করা প্রায়শই কঠিন হয়ে পড়ে। পেশাদার চক্রগুলো আসল নোটের নিরাপত্তা সুতা, জলছাপ এবং প্রিন্টের সূক্ষ্ম বিষয়গুলো নকল করার চেষ্টা করে। অনলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এই জাল নোট বিক্রির সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে, যা সমস্যার নতুন মাত্রা যোগ করেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশে এই জালিয়াত চক্র বর্তমানে ব্যাপকহারে তাদের জাল বিস্তার করেছে। অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে তারা টাকা জাল করে বাজারে ছাড়ছে। বিশেষ করে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জালিয়াত চক্র আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। কেননা এই সময় অর্থপ্রবাহ বেড়ে যায়।
জাল টাকা হলো একটি রাষ্ট্র বা সরকারের আইনি অনুমোদন ছাড়াই উৎপাদিত মুদ্রা, যা আসল মুদ্রার অনুকরণে তৈরি করা হয় এবং এর প্রাপককে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। জাল টাকা অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায় এবং দ্রব্যমূল্যের মূল্যবৃদ্ধিসহ নানান ধরনের ক্ষতি ডেকে আনে।
জালিয়াত চক্রের অনেককে পাকড়াও করা হলেও তারা আবার জামিনে বেরিয়ে এসে একই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। আইনের ফাঁক থাকায় এই ঘৃণ্য অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যায়। এদের বিরুদ্ধে মামলা হলেও সাক্ষীর অভাবে তা অনেক ক্ষেত্রে প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে। আর এভাবেই জালিয়াত চক্র সহজেই বড় ধরনের অপরাধ করেও পার পেয়ে যায়।
জালিয়াত চক্রকে যে এখনো সক্রিয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে। সাম্প্রতিকসময়ে বাংলাদেশে জাল টাকা তৈরি ও লেনদেনের অভিযোগে বেশ কয়েকটি চক্রকে আটক করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এর মধ্যে রয়েছে-
• চট্টগ্রামে ২০ কোটি টাকার জাল নোট উদ্ধার: গত ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে র্যাব চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও এলাকা থেকে দেশি-বিদেশি আনুমানিক ২০ কোটি টাকা সমমূল্যের বিপুল পরিমাণ জাল মুদ্রাসহ চক্রের দুই সদস্যকে (তানজিব উদ্দিন ও আসিফ উদ্দিন) গ্রেফতার করে। এই জাল নোটগুলো অনলাইনে বিক্রি করা হতো বলে জানা যায় এবং এতে বাংলাদেশি ১০০০, ২০০ ও ৫০ টাকার পাশাপাশি ইউএস ডলার, ইউরো, রিয়াল ও দিরহামের জাল মুদ্রা ছিল।
• রংপুরে জাল টাকা ব্যবহারকারী গ্রেফতার: গত ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে রংপুরে ওষুধ কেনার সময় জাল টাকা ব্যবহারের অভিযোগে এক ব্যক্তিকে (মো. নজরুল ইসলাম) পুলিশ গ্রেফতার করে। তার কাছ থেকে আরও কয়েকটি ১০০০ টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছিল।
• ঢাকায় জাল নোট তৈরি কারখানা ও ছয়জন আটক: গত ১৫ মে, ২০২৫ তারিখে ঢাকা ও পঞ্চগড়ে অভিযান চালিয়ে একটি জাল নোট তৈরি কারখানার সন্ধান পায় ডিবি পুলিশ এবং এই চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করে। তাদের কাছ থেকে জাল টাকা তৈরির সরঞ্জামসহ বিপুল পরিমাণ জাল মুদ্রা জব্দ করা হয়েছিল।
• শেরপুর প্রধান ডাকঘরে জাল নোট শনাক্ত: গত ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে শেরপুর প্রধান ডাকঘরে এক নারী সঞ্চয়পত্রের টাকা জমা দিতে এলে মেশিনে ১০০০ টাকার ৫৩টি জাল নোট ধরা পড়ে।