আসুন, কোলদের প্রতি মানবিক হই
মানুষের নাকি রাষ্ট্রের নির্মম ঔদাসীন্য ও হিংস্র বিদ্বেষের শিকার হলো অতি সংখ্যালঘু কোল জাতির পাঁচ পরিবার। ঘটনা এ রকম: প্রায় আড়াই দশক ধরে রুমালী হাসদাসহ পাঁচ কোল পরিবার এই ভূমিতে বসবাস করছিল। তারা জানত, জমিটা খাস এবং তাদের জাতভাই তিলক মাঝি, দিনু মাঝি, ভাদু মাঝিসহ কয়েকজনের নামে জমির রেকর্ড আছে।
রাজশাহী থেকে স্টিফেন সরেন আমাকে কাগজ পাঠিয়েছেন। আমি দেখলাম, এসএ রেকর্ডে এই কোলদের নাম আছে। তাদের অভিযোগ, জাতিতে হিন্দু সাজিয়ে এবরিজিনালদের জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন মকবুল হোসেন। তাঁর ওয়ারিশরা পরে আদালতে মামলা করেন। কোল পরিবারগুলো অভাব–অনটন ও নানা কারণে মামলার খোঁজ নিতে পারেনি। আদালত একতরফা রায় দেন।
২৭ অক্টোবর কোলদের মাটির বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। তারা আশ্রয় নেয় বাঁশঝাড়ে। পত্রিকায় দেখলাম, গোদাগাড়ী উপজেলার ইউএনও কোলদের দেখতে গিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনীয় সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রশাসনের প্রতি আমার অনুরোধ হলো, এই কোলদের পুনর্বাসনসহ জমির মামলার বিষয়ে সহায়তা করুন। বাদীর কাগজপত্র সঠিক কি না, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জমি হস্তান্তরে প্রজাস্বত্ব আইনের ৯৭ ধারা লঙ্ঘন হয়েছে কি না, এসব দেখা গুরুত্বপূর্ণ। কেন কোল সম্প্রদায় মামলার আপিল করেনি, সেটি দেখা। তারা কি আদৌ উকিল নিয়োগ করেছিল? আপিলের সুযোগ থাকলে আপিলের ব্যবস্থা করা জরুরি। আর মানবিক কারণে হলেও ওদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের কর্তব্য।
অনেক সময় বলা হয়, রাষ্ট্র এই অবহেলিত প্রান্তিক মানুষদের থেকে অনেক দূরে থাকে। এই দূরত্ব বাস রুটের বা সড়কপথের দূরত্ব নয়। অন্য এক দূরত্ব। দৃষ্টিভঙ্গির, অবহেলার, উপেক্ষার, না দেখার। সর্বোপরি অমর্যাদার। কেউ কি আমাকে বলবেন, কোনো কোল জাতির মানুষ কোনো দিন ডিসি অফিসে গেছেন কি না? ইউএনও অফিসে কোনো তথ্য কি আছে, কোনো কোল জাতির মানুষ দেখা করতে গেছেন? যদি গিয়ে থাকেন, কেমন রিসেপশন তিনি পেয়েছিলেন? নাকি গভীর এক হতাশা ও দুঃখ নিয়ে তাঁকে ফিরতে হয়েছে চিরচেনা তাঁর গ্রামে, যেখানে তাঁর থাকার ঘরের নিশ্চয়তা নেই? আমাদের সংবিধানে সব নাগরিকের সমান অধিকারের কথা লেখা আছে।
ভারতের সংবিধানে ট্রাইবালদের জন্য সমতা শুধু নয়, অগ্রাধিকারের কথা লেখা আছে। সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন, ‘কার্যকালে দশকের পর দশক ধরে শব্দগুলো সংবিধানে শোভা হয়ে থাকে এবং আদিবাসীদের দুঃখ চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার দপ্তর থেকে হতাশা নিয়ে ফিরে এসে আদিবাসীরা স্টেশনে উবু হয়ে বসে থাকে, ট্রেন ধরে, সাঁইত্রিশ মাইল হেঁটে গ্রামে ফেরে এবং অপরিচিত, হিংস্র আলোকোজ্জ্বল নয়া ভারত থেকে স্বীয় পরিবেশের অপরিমেয় অন্ধকারে ফিরে স্বস্তি পায় (জগমোহনের মৃত্যু)।’
আমি দেখলাম ২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশে কোল জাতির সংখ্যা মাত্র ৩ হাজার ৮২২। আর ২০১১ সালে ছিল ২ হাজার ৮৪৩ জন। তার আগে যেমন ২০০১ বা ১৯৯১ শুমারিতে তাদের নামই ছিল না। সরকারি রেকর্ডে তারা ছিল পরিচয়হীন। আমি ঢাকা শহরে কোল জাতির কোনো মানুষ খুঁজে পাইনি। অনেক বছর আগে প্রথম এক কোচ ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিল। ভর্তির আগে আমার কাছে এসেছিল একটু সাহায্যের জন্য। আমি তাকে বলেছিলাম, অর্থের অভাবে কোচ ছেলের পড়া হবে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেটি হওয়া উচিত হবে না। ছেলেটি বিসিএস ক্যাডারে চাকরি করছে এখন। কোলদের এখানে আসতে অনেক সময় লাগবে। আসুন, সবাই ওদের পাশে দাঁড়াই।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সংখ্যালঘু সম্প্রদায়