জুলাই সনদ: রাজনীতিতে যে সংকট তৈরি করতে পারে
অতি দীর্ঘ, পরিশ্রমসাধ্য একটি জার্নির পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তার কাজ শেষ করল। কমিশনকে অভিনন্দন। কিন্তু সর্বশেষ কমিশন যেভাবে তাদের সুপারিশ দিয়েছে, তা একদিকে যেমন কমিশনের এত দিনের কাজকে অর্থহীন বলে প্রমাণ করার ঝুঁকি তৈরি করেছে, অপর দিকে দেশকে ঠেলে দিতে পারে রাজনৈতিক সংঘাতের দিকে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল প্রাথমিকভাবে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করা এবং সেটার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা করা। সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে, সেটা তাদের কর্মপরিধির মধ্যে ছিল না। জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ জুলাইয়ের পর ঐকমত্য কমিশন সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলো ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক–অনানুষ্ঠানিক আলোচনা করে। দীর্ঘ আলোচনার পরও এ ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি কমিশন।
প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে পদ্ধতির কথা বলছে, তাতে দেখা যায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’-এর মাধ্যমে কিছু প্রস্তাব তাৎক্ষণিকভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এবং বাকিগুলোর যেগুলোতে সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন, সেগুলোকে গণভোটে দিয়ে জনগণের মতামত নিতে হবে। এরপর সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন করে এবং ওই সংস্কার পরিষদের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করতে হবে।
নির্বাচনের পরে ৯ মাসের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করার কথা বলা হয়েছে। গণভোটের ম্যান্ডেটের পরও সেই সংসদ যদি এই সংশোধনীগুলো বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ৯ মাসের মাথায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সবকিছু করিয়ে ফেলা যায় না, এই বাস্তবতা মাথায় নিয়ে আমাদের কর্মপদ্ধতি ঠিক করা উচিত। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী এই সংকট নিয়ে আলোচনা চলছে; শিগগিরই লিখতে চাই এই ইস্যুতেও।
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতিতে এর চেয়েও বড় সংকট আছে। ঐকমত্য কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সংবিধানের সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে গণভোটে রাজনৈতিক দলের ভিন্নমতের বিষয়ে উল্লেখ থাকবে না। ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, তার ওপরই গণভোট হবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ জয়ী হলে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই তা বাস্তবায়িত হবে।
কমিশনের এই সিদ্ধান্ত দেখে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে সনদ স্বাক্ষরের দিন স্বাক্ষর করা থেকে বিরত থাকা এনসিপির স্বাক্ষর শেষ মুহূর্তে নিশ্চিত করতে তাদের দেওয়া শর্ত মেনেই এমন প্রস্তাব করেছেন তাঁরা। রাজনৈতিক দর-কষাকষির জন্য এমন শর্ত দেওয়াটা চলতে পারে, কিন্তু সেটাকে সনদ স্বাক্ষরের অলঙ্ঘনীয় শর্ত বানিয়ে ফেলাটাকে রাজনৈতিক অপরিপক্বতা হিসেবে দেখা যেতে পারে। আর সেটা গ্রহণ করে ঐকমত্য কমিশন তার বিবেচনাবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
এটা মানতে দ্বিধা নেই, রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের বিভিন্ন ইস্যুতে ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) অনেক ক্ষেত্রেই অনেকের কাছে অযৌক্তিক বলে মনে হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়ে কোনো দল যদি ভিন্নমত প্রকাশ করে, তবে তাকে সম্মান জানানো উচিত। এখন যেভাবে গণভোটের প্রস্তাব করা হচ্ছে, তাতে প্রশ্ন আসতেই পারে, কেন মাসের পর মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অতি দীর্ঘ আলোচনা করা হলো?
প্রাথমিক ছয় কমিশন তো রাজনৈতিক দলগুলোসহ সব অংশীজনের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমেই তাদের সুপারিশ প্রদান করেছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য হিসেবে আমি জানি সেই সুপারিশ তৈরির জন্য কত রকম অংশীজনের কাছ থেকে মতামত নেওয়া এবং সেটা বিবেচনা করা হয়েছে। এসব কমিশনের সুপারিশ থেকে বিবেচনা করে একটি চূড়ান্ত সুপারিশ করার মতো যথেষ্ট বিজ্ঞ সদস্যরা আছেন ঐকমত্য কমিশনে। এরপর সেটা এখন যেভাবে গণভোটে দেওয়ার কথা হচ্ছে, সেভাবে গণভোটে দিয়ে দেওয়া যেত।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আলোচনায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল নিজেদের পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে অনেক ক্ষেত্রেই সরে এসে অনেক সাংবিধানিক সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছে। এই একমত হওয়ার সুবিধা যেমন আমাদের নেওয়া উচিত, তেমনি তাদের ভিন্নমতকেও মর্যাদা দেওয়া উচিত। ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাবিত গণভোট একটি মারাত্মক সংকট তৈরি করতে পারে। ভিন্নমত যুক্ত করা ছাড়া প্রস্তাবগুলো সব যদি প্যাকেজ আকারে গণভোটে যায়, তাহলে দেশে কার্যকর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দলটি (বিএনপি) সেই গণভোটে কী অবস্থান নেবে?
- ট্যাগ:
- মতামত
- রাজনৈতিক সংকট
- জুলাই সনদ