রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : নির্বাচন ভাবনা

যুগান্তর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) রোকন উদ্দিন প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০২৫, ১১:৫৯

গত শনিবার দৈনিক যুগান্তর আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী। কবি ও সম্পাদক আবদুল হাই শিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিশিষ্ট পণ্ডিত, লেখক, সাংবাদিক ও থিংক ট্যাংকরা অংশ নেন। দেশের এই ক্রান্তিকালে এমন একটি আয়োজন প্রশংসার দাবি রাখে। এ বৈঠকে প্রায় সবাই একমত হন যে, বর্তমান সময়ে জাতীয় ঐক্যই বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতির প্রধান শর্ত। আমি আলোচনায় যে বিষয়গুলো তুলে ধরেছি, তা মূলত এই ঐক্যের ধারাবাহিকতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তার ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল। জুলাই বিপ্লবের পর যে ঐক্যের চেতনা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটিকে ম্লান হতে দেওয়া যাবে না। কারণ সেই ঐক্যই ছিল জাতীয় পুনর্জাগরণের স্বপ্নের প্রতীক।


আমি জোর দিয়ে বলেছি, রাজনৈতিক ঐক্য টিকিয়ে রাখতে হলে আগে দলগুলোকেই নিজেদের ভেতরে সংস্কার আনতে হবে। প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে নিজস্ব সাংগঠনিক শৃঙ্খলা পুনর্গঠিত করতে হবে। যে দল অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলায় আক্রান্ত, নেতৃত্বে দুর্নীতি বা স্বার্থান্ধতা প্রবল, তারা কখনোই জাতীয় ঐক্যের স্তম্ভ হতে পারে না। এখন সময় এসেছে নতুন ধারার রাজনীতির, এমন রাজনীতি যা হবে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন। পুরোনো ধাঁচের ক্ষমতাকেন্দ্রিক, স্বার্থান্বেষী ও মুখোমুখি রাজনীতির যুগ শেষ হয়ে গেছে। তরুণ প্রজন্মের মেধাবী, সৎ ও দূরদর্শী নেতৃত্বকে সামনে আনতে হবে। বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা, যারা জাতির জন্য বহু বছর কাজ করেছেন, তাদের এখন দায়িত্ব তরুণদের হাতে নেতৃত্বের ভার অর্পণ করা। এই প্রজন্মান্তরের নেতৃত্ব পরিবর্তন যদি সুষ্ঠুভাবে হয়, তাহলে রাজনীতিতে নতুন উদ্যম, নতুন বিশ্বাস ফিরে আসবে।


আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করি, তা হলো আসন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদান প্রক্রিয়া। যদি আমরা সত্যিই সুশাসন ও গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে চাই, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোকে অপরাধী, দুর্নীতিবাজ ও অশিক্ষিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকতে হবে। যাদের জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা নেই, তাদের প্রার্থী করা জাতির প্রতি অবিচার। দলগুলোকে মনোনয়ন দেওয়ার আগে প্রার্থীদের চরিত্র, শিক্ষা ও সেবার মানসিকতা কঠোরভাবে যাচাই করতে হবে। নৈতিকভাবে যোগ্য ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদেরকেই নেতৃত্বে আনতে হবে, না হলে রাজনীতি অপরাধ আর দুর্নীতির ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খেতেই থাকবে।


আমি আইনশৃঙ্খলার বিষয়েও গুরুত্ব দিয়ে বলেছি। সরকার যে কিছুটা উন্নতির দাবি করছে, সেটি যেন আত্মতুষ্টির কারণ না হয়। মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ভিন্ন, তা বোঝার জন্য গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রশাসনিক তথ্য বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। দেশে এখনো অনেক অপরাধচক্র সক্রিয় এবং প্রচুর অবৈধ অস্ত্র জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে আছে। সন্ত্রাসী ছাত্র লীগসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনের কাছে থাকা অস্ত্র ও বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র জনজীবনে হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই অবিলম্বে যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে সারা দেশে বিশেষ অভিযান চালিয়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও অপরাধচক্র ভেঙে দিতে হবে। এটি শুধু নির্বাচনি পরিবেশ নিরাপদ করবে না, বরং রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের আস্থাও ফিরিয়ে আনবে। মাঠে যে সেনাসদস্যরা আছে, তাদের সংখ্যা অপর্যাপ্ত।


নির্বাচন ব্যবস্থাপনায় নিযুক্ত প্রশাসনের দিকেও বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। যদি মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পক্ষপাতদুষ্ট হন, তাহলে কোনোভাবেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এজন্যই আমি জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং অন্য নির্বাচনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ব্যাপক পুনর্বিন্যাস ও পরিবর্তনের আহ্বান জানাই। এই প্রশাসনিক ‘শুদ্ধি অভিযান’ ছাড়া সমান সুযোগের নির্বাচন বা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করা যাবে না। নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রশাসন নির্বাচনের পূর্বশর্ত।


আমি আরও জোর দিয়ে বলেছি, এখনই সময় সতর্ক থাকার। দেশের অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুরা সব সময় সুযোগ খোঁজে-রাজনৈতিক পরিবর্তন, নির্বাচনকালীন উত্তেজনা বা নেতৃত্বের অস্থির মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে তারা নানারকম নাশকতা, উসকানি ও ষড়যন্ত্র চালাতে চায়। অতীত ইতিহাসে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি হলে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের এজেন্টরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে, ধর্ম, জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাসের বীজ বপন করে, যাতে জনগণ ঐক্য হারিয়ে বিভ্রান্ত হয়।


চট্টগ্রাম পাহাড়ি অঞ্চলের মতো সংবেদনশীল এলাকাগুলো এ ধরনের ষড়যন্ত্রের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ও তাদের বিদেশি সমর্থকরা আবারও অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। তারা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে মিথ্যা প্রচার চালাতে পারে, সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীকে বিতর্কিত করতে চেষ্টা করতে পারে, এমনকি আন্তর্জাতিক মহলেও বিভ্রান্তি ছড়াতে পারে। পাশাপাশি, দেশের সংখ্যালঘু ইস্যুকে ব্যবহার করে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টির প্রচেষ্টা নতুনভাবে দেখা দিচ্ছে। এ কৌশলটি অত্যন্ত পুরোনো-দেশকে অস্থিতিশীল করার সবচেয়ে সহজ অস্ত্র হলো ধর্মীয় বিভেদ। যখন মানুষ পরস্পরের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়, তখন জাতীয় ঐক্য দুর্বল হয়, আর ঠিক তখনই শত্রুরা আঘাত হানতে সুবিধা পায়।


সম্প্রতি আমরা লক্ষ্য করেছি, দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন লাগছে, যা নিছক দুর্ঘটনা বলে মনে করা যাচ্ছে না। জুট মিল, গার্মেন্ট কারখানা, বাজার, পরিবহণ টার্মিনাল-এসব স্থানে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড নিঃসন্দেহে সন্দেহজনক। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলোতেও এমন অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে আমাদের শিল্প-অর্থনীতি ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। আজও সেই পুরোনো কৌশল নতুন রূপে ফিরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। এর পেছনে সুপরিকল্পিত হাত আছে, যা দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ নষ্ট করতে, জনগণের মনে ভয় সৃষ্টি করতে এবং সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে চায়।


একই সঙ্গে উদ্বেগজনকভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে, হিন্দুত্ববাদী প্রভাবাধীন একটি বিতর্কিত সংগঠন বিভিন্ন অঞ্চলে উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। তাদের কিছু নেতার বক্তব্য, কর্মকাণ্ড ও প্রদর্শনী এমনভাবে সাজানো হচ্ছে যা মুসলিম সম্প্রদায়ের অনুভূতিকে আহত করে এবং অপ্রয়োজনীয় ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করে। এ সংগঠনটি ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে আদর্শিকভাবে সংযুক্ত, এবং তাদের কিছু অংশ বাংলাদেশে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে বিদেশি স্বার্থে কাজ করছে বলে বিভিন্ন সূত্রে ধারণা পাওয়া যায়। তারা ধর্মীয় অনুশীলনের আড়ালে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে, যা দেশের শান্তি, সহাবস্থান ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য মারাত্মক হুমকি।


এই পরিস্থিতি ইঙ্গিত দেয়, একটি গভীর পরিকল্পনা কাজ করছে, যেখানে একদিকে অগ্নিসন্ত্রাসের মাধ্যমে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে, অন্যদিকে ধর্মীয় উসকানির মাধ্যমে সমাজকে বিভক্ত করার চেষ্টা চলছে। এসব ঘটনার পেছনে লক্ষ্য একটাই-নির্বাচনের আগে দেশকে অস্থিতিশীল করা, আন্তর্জাতিক মহলে অরাজকতার চিত্র তুলে ধরা এবং অভ্যন্তরীণ ঐক্যকে দুর্বল করা। এটি নিছক বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা নয়, বরং একটি ধারাবাহিক কৌশলের অংশ।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও