এ বছরের জুনে পাকিস্তান যখন আনুষ্ঠানিকভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করে, তখন অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন এ ঘটনায়। এরপর গত ১৩ অক্টোবর মিসরের শার্ম আল শেখে অনুষ্ঠিত গাজা সম্মেলনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ দ্বিতীয়বারের মতো দেশটির এ ইচ্ছার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন, যদিও এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন ভেনিজুয়েলার মারিয়া কোরিনা মাচাদো। তা সত্ত্বেও অনেকের মনে প্রশ্ন রয়েছে, পাকিস্তান কেন নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম সুপারিশ করেছিল।
এ প্রশ্নের জবাব অতি সহজ-পাকিস্তান বর্তমানে চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের। এ থেকে ইসলামাবাদের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে পাকিস্তান অতি সঙ্গোপনে যুক্তরাষ্ট্রে ‘বিরল খনিজদ্রব্যের’ নমুনা পাঠিয়েছে এবং একটি রপ্তানি চুক্তির পথও খুঁজছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রও পাকিস্তানকে নতুন দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে আফগানিস্তান প্রশ্নে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আকস্মিক প্রস্থানে সেখানে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা পূরণের চেষ্টা চলছে নানাভাবে। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের পাঁচ বছর পর দেশটির বাগরাম বিমানঘাঁটি হস্তান্তরের ট্রাম্পের দাবি থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতি বজায় রাখতে সাহায্য করার জন্য পাকিস্তানই একমাত্র রাষ্ট্র, যার রয়েছে লজিস্টিক সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক যোগাযোগ। শত্রুভাবাপন্ন ইরান এবং ক্ষমতাসীন তালেবানের বিপরীতে এ অঞ্চলে ভারসাম্য রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি পালটা শক্তিকে প্রয়োজন। আর সেটা হতে পারে পাকিস্তান। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্কেও এখন অস্বস্তি বিরাজ করছে। এর আগে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত ক্ষেত্রে দুদেশের সম্পর্কের এক ধরনের ঘনিষ্ঠতা লক্ষ করা যাচ্ছিল। কিন্তু বর্তমানে ভিসা ও শুল্ক নিয়ে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতাও যুক্তরাষ্ট্রকে চিন্তায় ফেলেছে।
এদিকে গত মাসে পাকিস্তান সৌদি আরবের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেছে। এই চুক্তির অধীনে এক দেশের ওপর আক্রমণকে উভয় দেশের ওপর আক্রমণ হিসাবে বিবেচনা করা হবে, যা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরা এ অঞ্চলে সম্পর্কের নতুন মেরুকরণের লক্ষণ।
স্নায়ুযুদ্ধের যুগে এ অঞ্চলে পাকিস্তান ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র। এর পেছনে নানা কারণও ছিল। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সব ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে সহায়তা দিয়েছে। বস্তুত পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকে দেশটির পররাষ্ট্রনীতি মূলত সামরিক নিরাপত্তা এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর নির্ভরশীল ছিল। দীর্ঘকাল ধরে ভারতকেন্দ্রিক নিরাপত্তা ভাবনা, কাশ্মীর সমস্যা এবং পশ্চিমা সামরিক জোটের (সেন্টো, সিয়াটো) সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এই নীতির মূল ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতা, নাইন-ইলেভেনের ঘটনা ও পাশ্চাত্যের ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ’ এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিও সেই আবর্তেই পরিচালিত হয়েছে। তবে গত কয়েক বছর ধরে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তন লক্ষণীয়। দেশটি এখন তার ঐতিহ্যবাহী ‘নিরাপত্তাকেন্দ্রিক’ নীতির পাশাপাশি ‘অর্থনৈতিক কূটনীতি’ এবং ‘আঞ্চলিক সংযোগে’র ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
আমরা জানি, বর্তমানে পাকিস্তান এক গভীর অর্থনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এ সংকট থেকে উত্তরণের প্রধান উপায় হিসাবে পাকিস্তান বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছে। ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী’ যুদ্ধের সময়ের সামরিক নির্ভরতা কমিয়ে পাকিস্তান এখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও অন্যান্য ক্ষেত্রে একটি ব্যাপকভিত্তিক সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে। তারা সামরিক সাহায্যকারী থেকে অর্থনৈতিক অংশীদারে রূপান্তরিত হতে চাইছে।
প্রয়োজন ও নিরাপত্তা তথা জাতীয় স্বার্থেই গড়ে তোলা হয় একটি দেশের পররাষ্ট্রনীতি। বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন এবং বহুপাক্ষিক সম্পর্কের উত্থান পাকিস্তানকে বাধ্য করেছে শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরশীল না থেকে একটি ভারসাম্যমূলক নীতি গ্রহণ করতে। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ঐতিহ্যবাহী মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার পাশাপাশি ইরান ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক গভীর করার চেষ্টা করছে পাকিস্তান। আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতা দখলের পর সীমান্তে স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখার গুরুত্ব বেড়েছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের তাগিদ অনুভব করছে পাকিস্তান।
সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে । বাণিজ্য, যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠকের উদ্যোগ এবং মন্ত্রী পর্যায়ের সফরের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। দক্ষিণ এশিয়ায় বর্তমানে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্কে যে নেতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, পাকিস্তান হয়তো চেষ্টা করবে সেটাকে কাজে লাগিয়ে অন্য দেশগুলোকে কাছে টানতে। সেক্ষেত্রে দেশটিকে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে অগ্রসর হতে হবে।