সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা তথা রাজনৈতিক স্থিরতার অভাবে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে প্রবৃদ্ধিতে ব্যাপক ভাটা দৃশ্যমান। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য চার ধরনের চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো বেসরকারি বিনিয়োগে শ্লথগতি, কর্মসংস্থানে স্থবিরতা, ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংক খাত ও রাজস্ব আদায়ে ক্রমাবনতি। শুধু বিশ্ব ব্যাংক নয়, দেশের অর্থনীতিবিদরাও সরকারকে অর্থনীতি ঠিক পথে পরিচালিত করতে, বিভিন্ন খাতে সংস্কারের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটানোর তাগিদ দিয়ে আসছেন। এ কথা সত্য যে, ২০২৪-এর ৫ আগস্টের পর থেকে নাগরিকদের একটা বড় উদ্বেগের কারণ দেশের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। গত প্রায় ১৫ মাসেও পুলিশ তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারেনি। মব-সহিংসতা, চুরি, ডাকাতি, অপহরণ, চাঁদাবাজি, মুক্তিপণের মতো অপরাধ আশঙ্কাজনকভাবে বাড়লেও এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এই বিষয়গুলো বেসরকারি বিনিয়োগে সরাসরি প্রভাব পড়ছে। ফলে বাড়ছে না কর্মসংস্থান গতি বরং প্রতিদিনই কর্ম হারাচ্ছে মানুষ।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে এক বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্য বেড়েছে। শ্রমশক্তিতে নারী-পুরুষের অংশগ্রহণের হার কমেছে। তারা আরও বলছে, ৩০ লাখ কর্মক্ষম নারী-পুরুষ শ্রমশক্তির বাইরে চলে গেছেন, যার ২৪ লাখই নারী। এ পরিসংখ্যান অত্যন্ত উদ্বেগজনক। নারীর ক্ষমতায়নে যেখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো দরকার, সেখানে এই উল্টোযাত্রা ভাবিয়ে তোলার মতো। দারিদ্র্য ও অতি দারিদ্র্যের সংখ্যা যে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে, সেটা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন পিপিআরসির সাম্প্রতিক গবেষণাতেও উঠে এসেছে। সংস্থাটির প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দেশে এখন দারিদ্র্যের হার ২৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
নেতিবাচক এই পরিসংখ্যানগুলো বলছে, দেশে বেকারের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। চাকরির বাজার সংকুচিত হয়ে পড়ায় ভোগান্তির মুখে শিক্ষিত বেকাররাও। অথচ জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ছিল চাকরি প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক কড়া প্রতিবাদ। গত প্রায় ১৫ মাসে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সি যুব বেকারদের মধ্যে প্রায় ২৯ শতাংশ স্নাতক। দেশে এক বছরের ব্যবধানে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে ১ লাখ ৬০ হাজার। ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেকারের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ ২০ হাজার, যা ২০২৩ সালে ছিল ২৪ লাখ ৬০ হাজার। অন্য যে কোনো বিভাগের তুলনায় চাকরির খোঁজে ঢাকাতেই অবস্থান করেন বেশির ভাগ বেকার। যাদের অনেকেই আবার উচ্চশিক্ষিত। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের শ্রমবাজারে নিরক্ষর শ্রমিকের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে কাজে নিয়োজিতদের ৮৪ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে। গ্রামে এ হার ৮৭ দশমিক ৫৮ শতাংশ, শহরে ৭৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। নিরক্ষর কর্মশক্তি দেশের অর্থনীতির উৎপাদনশীলতায় তৈরি করছে সীমাবদ্ধতা। বিশেষ করে শিল্প ও সেবা খাতে দক্ষতা ঘাটতির কারণে অনেকে কাজ পেলেও উচিত মূল্য পাচ্ছেন না। কর্মসংস্থানের কাঠামোতেও বড় বৈষম্য ধরা পড়েছে। বিপুল শ্রমশক্তি এখনও সুরক্ষাহীন, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত। শিক্ষিত বেকারের হার বেপরোয়াভাবে বৃদ্ধির প্রবণতা সমাজে হতাশা সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও তা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষিত বেকারদের এক ক্ষুদ্র অংশ বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করলেও অন্য অংশ হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেশে বেকারের যে তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগের। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, লাখ লাখ বেকারের এই দেশে দক্ষ জনশক্তির অভাবও প্রকট। দেশের উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে শিক্ষিত বেকার সৃষ্টির বদলে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে ব্যবহৃত হয়, সে উদ্দেশে সরকারকে এখনই সক্রিয় হতে হবে।
আসলে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘ সময় ধরে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে আসছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক সংকটে সেই প্রবৃদ্ধি এখন নানা চাপে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি, জ্বালানি সংকট ও বিনিয়োগে স্থবিরতা- সব মিলিয়ে শ্রমবাজারে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফলাফল- বেকারত্ব ভয়াবহভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করা তরুণদের এক বড় অংশ আজ কর্মহীন এবং গ্রামাঞ্চলে কৃষির বাইরে বিকল্প কর্মসংস্থান না থাকায় শহরমুখী বেকারের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এ সংকট জাতীয় স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ সরাসরি বেকার, তবে অনানুষ্ঠানিক ও আংশিক বেকারদের অন্তর্ভুক্ত করলে এ সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ছাড়িয়ে যায়। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশ কোনো না কোনোভাবে অপ্রতুল কাজে নিয়োজিত- অর্থাৎ তারা কাজ করছে, কিন্তু তাদের আয় জীবিকা নির্বাহের জন্য যথেষ্ট নয়। শহরের তুলনায় গ্রামীণ অঞ্চলে আংশিক বেকারত্ব বেশি। কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে শিল্প ও সেবা খাতে রূপান্তর ঘটলেও সেই হারে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। জানা যায়, প্রতিবছর প্রায় ২০ লাখ নতুন তরুণ শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, কিন্তু নতুন চাকরি তৈরি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৭-৮ লাখ। বাকিরা হয় বেকার থেকে যাচ্ছে, নয়তো অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে অনিশ্চিত কাজে নিযুক্ত হচ্ছে। এতে দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ- তরুণ জনগোষ্ঠী আজ ক্রমে হতাশ হয়ে পড়ছে।