শত্রুর সঙ্গে বসবাস!
এই সমাজে ভালোবাসা যেন এক অলীক গল্প—যার শুরু আছে, কিন্তু শেষটা কেউ জানে না! এ যেন নাম না জানা এক অসুখ, যার সুনির্দিষ্ট ওষুধের অভাব! স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক এখন অনেক সময় শুধু ভালোবাসার নয়, বরং আধিপত্যের অনুশীলন। যেখানে পুরুষ নিজেকে ক্ষমতাধর ভাবে, আর নারীকে ভাবে কেবল নীরব সহচর। একজন বিবাহিত নারী যেন পুরুষের পকেটে থাকা কড়কড়ে নোট, চাহিবা মাত্র ইহার বাহককে দিতে বাধ্য থাকবে৷ মানুষের ভেতরকার কান্না কেউ শোনে না। দরজার ওপাশে শিশুর হাসি বাজে, ভেতরে এক নারী ভেঙে পড়ছে ধীরে ধীরে—অপরাধ তার শুধু এই যে, সে “স্ত্রী”। প্রেম সেখানে বাধ্যতা, আর সম্মতি সেখানে এক নিঃশব্দ আতঙ্ক। সমাজ তাকিয়ে থাকে, কিন্তু দেখে না; শোনে, কিন্তু দায় নেয় না। আর এই নীরবতায় ডুবে যায় একের পর এক জীবন, একের পর এক নারী।
আমরা এমন এক সময়ে আছি, যেখানে মানুষ প্রতিদিন শত শত শব্দ বলে, কিন্তু একটিও কথা বলে না। চোখে চোখ রাখার সময় নেই, অথচ সারাদিন স্ক্রিনে অচেনা মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিই। আমাদের সম্পর্কগুলো এখন নিঃশব্দ চুক্তি—বিছানায় শরীর আছে, টেবিলে খাবার আছে, ঘরে হাসির শব্দও আছে, কিন্তু নেই কথার উষ্ণতা। এই নীরবতা শুধু দূরত্ব নয়, এটি ধীরে ধীরে সম্পর্কের মৃত্যু। আর এই মৃত্যু এত নিঃশব্দ যে, আমরা তা টের পাই তখনই, যখন ভালোবাসার মানুষটা পাশে থেকেও অচেনা হয়ে যায়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর সাম্প্রতিক জরিপে উঠে এসেছে এক ভয়ংকর তথ্য— দেশের প্রতি তিনজন বিবাহিত নারীর একজন স্বামীর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার। এটি শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়; এটি এক অব্যক্ত আর্তনাদ, যা আমাদের সমাজের পর্দার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে চলা নীরব সহিংসতার প্রতিধ্বনি।
আমরা প্রায়ই ধর্ষণ, নির্যাতন বা যৌন সহিংসতা নিয়ে আলোচনা করি যখন তা জনসমক্ষে ঘটে। কিন্তু ঘরের ভেতরে, শয্যার পাশে, কিংবা বৈবাহিক সম্পর্কের নামে যে সহিংসতা প্রতিদিন ঘটে চলেছে, সেটি নিয়ে সমাজে এক অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছে। কারণ, আমরা এখনো বিশ্বাস করতে শিখিনি যে “বিবাহ মানেই শরীরের সম্মতি নয়।”
বিবাহ একটি সামাজিক চুক্তি, কিন্তু যৌন সম্পর্ক একটি পারস্পরিক সম্মতির বিষয়। অনেক পুরুষ এই মৌলিক পার্থক্যটি বুঝতে বা মানতে চায় না। ফলে, “স্ত্রী তো আমারই” এই ধারণা থেকেই জন্ম নেয় বৈবাহিক যৌন নির্যাতনের ভয়াবহ সংস্কৃতি। নারীর শরীর তার নিজের, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছাই নির্ধারণ করবে সম্পর্কের সীমা। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, সমাজে এখনো নারীর নীরবতাকে সম্মতির সমান ধরা হয়। স্বামী যদি জোর করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে, অনেক নারী সেটিকে নির্যাতন বলতেই ভয় পায়। কারণ, সমাজ ও পরিবার তখন তাকে দোষারোপ করে, প্রশ্ন তোলে— “স্বামী হলে আবার নির্যাতন কীভাবে হয়?” এই অজ্ঞানতা ও সংস্কারই নারীদের নির্যাতনের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক।
বাংলাদেশে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’-এ যৌন নির্যাতনের বিষয়টি উল্লেখ আছে, কিন্তু বৈবাহিক ধর্ষণ এখনো স্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃত নয়। ফলে, নারীরা আইনি সহায়তা নিতে পারেন না। এমনকি পুলিশ বা সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও অনেক সময় এমন অভিযোগকে ‘বাড়ির বিষয়’ বলে এড়িয়ে যান। আইন যখন নীরব, তখন ন্যায়বিচারও দূরের স্বপ্ন হয়ে যায়। আসলে সমাধান শুধু আইনে নয়, মনোভাবে। এই সমস্যা মোকাবিলা করতে হলে প্রথমেই মানসিকতা পরিবর্তন জরুরি। শিক্ষা ব্যবস্থায় লিঙ্গসমতা ও যৌন সম্মতির বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
ছেলেদের ছোটবেলা থেকেই শেখাতে হবে— ভালোবাসা মানে অধিকার নয়, সম্মান। গণমাধ্যমে নারীর প্রতি ইতিবাচক ও সম্মানজনক বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। নারীদের জন্য নিরাপদ অভিযোগ ব্যবস্থা ও মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। একজন নারী যখন নিজের স্বামীর হাতে নির্যাতিত হন, তখন সেটি শুধু তার ব্যক্তিগত ক্ষত নয়— এটি সমাজের নৈতিকতার পরাজয়। যে সমাজে নারী ভালোবাসার মানুষটির কাছ থেকেও নিরাপত্তা খুঁজে পায় না, সেই সমাজ সভ্যতার মুখোশ পরলেও আসলে অসুস্থ। সময় এসেছে, এই অসুস্থতার মুখোমুখি হওয়ার। সময় এসেছে, নীরব নারীর কণ্ঠস্বর শোনার।