সি চিন পিংয়ের কীসের এত ভয়!
ক্ষমতায় আসার পর গত ১৩ বছরে সি চিন পিং চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি), রাষ্ট্রযন্ত্র, সামরিক বাহিনীসহ দেশটির সব ধরনের ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ একচ্ছত্রভাবে নিজের মুঠোয় নিয়েছেন। একই সঙ্গে সামাজিক জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়ে পর্যন্ত নজরদারি বিস্তৃত করেছেন। এরপরও সম্প্রতি নয়জন শীর্ষ জেনারেলসহ সামরিক নেতৃত্বে তাঁর ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালানো দেখে বোঝা যায়, এত ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের পরও তিনি সবখানেই শত্রু দেখতে পান।
২০১২ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর সি সিপিসি ও পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) ভেতরে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেন। একদলীয় চীনা ব্যবস্থায় দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার দীর্ঘদিনের বাস্তবতা ছিল।
এ কারণে অভিযানের শুরুটা বেশ জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু দ্রুতই প্রমাণিত হয়, এ তৎপরতা ছিল বেছে বেছে সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে ছেঁটে ফেলা। অর্থাৎ সেই শুদ্ধি অভিযানের মূল লক্ষ্য স্বচ্ছ বা কার্যকর শাসনব্যবস্থা গড়া ছিল না; বরং এটি ছিল সির ব্যক্তিগত ক্ষমতা পোক্ত করার কৌশল। এত দিনে প্রমাণিত হয়েছে, সির চীনে যোগ্যতা বা সততার চেয়ে ‘নেতার ব্যক্তিগত আস্থা অর্জন’ বেশি মূল্য পেয়ে থাকে।
এক দশকের বেশি সময় ধরে সি কেবল বিশ্বস্তজনদের পদোন্নতি দিচ্ছেন এবং নিজের বলয়ের বাইরের কর্মকর্তাদের, এমনকি শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদেরও বরখাস্ত করে চলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের হিসাবে, চীনে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ লাখ সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। এর বাইরে বহু মানুষ আচমকা নিখোঁজ হয়েছেন এবং তাঁদের লাপাত্তা হওয়ার বিষয়ে সরকারের দিক থেকে কোনো ব্যাখ্যাও নেই।
সির পুরোনো কায়দা অনুসরণে এবারও সরকার দাবি করেছে, সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযানে যেসব শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা ধরা পড়েছেন (তাঁদের মধ্যে আছেন পলিটব্যুরো সদস্য, কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের উপসভাপতি এবং চীনা সামরিক কাঠামোর তৃতীয় শীর্ষ ব্যক্তিত্ব জেনারেল হে ওয়েদং), তাঁরা ‘শৃঙ্খলাভঙ্গ’ ও ‘দায়িত্ব পালনে অবহেলার অপরাধ’ করেছেন। কিন্তু সরকারের দেওয়া ব্যাখ্যার চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হলো সি আসলে এক অন্তহীন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী দমন খেলা’ খেলছেন। আর সে খেলার একমাত্র লক্ষ্য হলো যেভাবেই হোক নিজের ক্ষমতা ধরে রাখা।
সির এই ভয় যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, তা কিন্তু নয়। প্রতিটি নতুন শুদ্ধি অভিযান চীনা অভিজাত শ্রেণির ভেতরে অবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয় এবং অনেক সময় অনুগত ব্যক্তিদেরও শত্রুতে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। ইতিহাসে এর বহু প্রমাণ পাওয়া যায়। মাও সে–তুং থেকে স্তালিনের একক শাসন শেষ পর্যন্ত প্যারানয়া বা অহেতুক সন্দেহবাতিক প্রবণতার জন্ম দেয়।
সির সাম্প্রতিক আচরণে মনে হয়, তিনি এত দিনে হয়তো শত্রু আর মিত্রের পার্থক্য করার ক্ষমতাই হারাতে বসেছেন। ৭২ বছর বয়সেও তিনি এতটাই অনিরাপদ বোধ করেন যে মাও যেটা করেছিলেন, সেটিও তিনি করতে রাজি নন। অর্থাৎ তিনি কোনো উত্তরসূরি মনোনয়ন পর্যন্ত করেননি। কারণ, তাঁর ভয়—কাউকে উত্তরাধিকারী হিসেবে ঘোষণা করলে তা তাঁর নিজের পতন ত্বরান্বিত করতে পারে।