
‘ভালো বউ পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার’
তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জিতেছিল বাংলাদেশ। যে জয়ের মহিমা এ দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের আলাদা করে বোঝানোর দরকার নেই। পরের বছর হায়দরাবাদে কেনিয়ার বিপক্ষে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম জয়টাও তাঁর নেতৃত্বে। ৮ টেস্ট ও ৪৪ ওয়ানডের ক্যারিয়ার শেষেও তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট থেকে হারিয়ে যাননি। নির্বাচক, প্রধান নির্বাচক,বোর্ড পরিচালক—অনেক পরিচয়েই দেখা গেছে তাঁকে। তারেক মাহমুদকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে চেনা যাবে ব্যক্তি আকরাম খানকেও।
জাতীয় দলে খেলছেন, অধিনায়কত্ব করেছেন। খেলোয়াড়ি জীবন শেষে নির্বাচক ও বোর্ড পরিচালক হয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনও খুব গোছানো। সাবিনা ভাবির সঙ্গে আপনার সুখী দাম্পত্য জীবনের তো অনেক খ্যাতি। এক জীবনে এত কিছু...কোনটা বেশি উপভোগ্য মনে হয়েছে?
আকরাম খান: (হাসি) সবই দারুণ! প্রেমের আগে তো আমার জীবনে ক্রিকেট এসেছে। খেলাটা খুবই উপভোগ করতাম। আমি বলব, আমাদের প্রজন্ম সৌভাগ্যবান। কারণ, আমাদের মাত্র দুটো অপশন ছিল—লেখাপড়া আর খেলাধুলা। এখনকার মতো ডিভাইস ছিল না। বিটিভিতে এক সপ্তাহ পরপর মুভি অব দ্য উইক দেখাত, ‘সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান’, ‘ফলগাই’ ছিল। এ রকম সিনেমাগুলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। স্কুল থেকে এসে মাঠে চলে যেতাম, রাতে হয়তো টিভিতে কোনো একটা সিনেমা-নাটক থাকত। এর বাইরে কিছু করার ছিল না। আর আমাদের পরিবারটাই ছিল খেলাপাগল। আপনি জানেন, আমার বড় ভাই (জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার নাফিস ইকবাল ও তামিম ইকবালের বাবা প্রয়াত ইকবাল খান) ফুটবল খেলতেন। আমার জন্য মজার ব্যাপার ছিল আমি ফুটবল, ক্রিকেট দুটোই খেলতাম। সাবিনাদের বাসা ছিল আমাদের বাসার পাশেই। আমাদের বারান্দা থেকে ওদের বারান্দা দেখা যেত। আমি বারান্দায় যেতাম, সে–ও আসত। আমাদের বারান্দাটা ছিল অনেক লম্বা। এমনও দিন গেছে, আমি তিন-চার ঘণ্টা বারান্দায় ব্যাটিং প্র্যাকটিস করতাম। আমার বন্ধু শ্যামল টেনিস বল ছুড়ে মারত। সাবিনা ওদের বারান্দা থেকে দেখত। অ্যারোপ্লেন টেনিস বল তখন আমাদের কাছে বেশ দামি। বারান্দায় নেট লাগিয়ে নিয়েছিলাম যেন বল নিচে পড়ে হারিয়ে না যায়। জানালার কাচ ভেঙেছি অনেক।
ওটা আসলেই প্র্যাকটিস ছিল, নাকি ভাবিকে দেখানোর জন্য...!
আকরাম খান: প্র্যাকটিসই ছিল, আবার ওকেও দেখতাম (হাসি)। সে অবশ্য বেশিক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত না। তবে দেখত...। পরে তো ঢাকায় চলে এলাম খেলতে। খেলার ব্যাপারে পরিবার থেকে পুরো সমর্থন ছিল, বিশেষ করে আম্মা অনেক উৎসাহ দিতেন।
আপনাদের যৌথ পরিবার ছিল। প্রচুর বন্ধুবান্ধবও নিশ্চয়ই ছিল চট্টগ্রামে। যখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলেন লিগ খেলতে, শুরুর দিনগুলো কেমন ছিল?
আকরাম খান: খেলার জন্য ছোটবেলায়ই বাসা থেকে বের হয়ে গেছি, ’৮৪-৮৫ সালে হবে। ঢাকায় এসে প্রথম রেলওয়ে ক্লাবে খেললাম। চট্টগ্রামের বাসার পরিবেশ খুব মিস করতাম। শুরুর দিকে একা একা থাকতাম। আমি ছাড়া আমার ভাই-বোন সবাই একসঙ্গে চট্টগ্রামের বাসাতেই থাকত। আমাদের বাসার কালচার ছিল, সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব। বড় ভাইয়ের ফুটবল খেলার সুবাদে বাসায় তখন অনেক সুপারস্টার আসতেন। মুন্না ভাই তখন বাংলাদেশের সুপারস্টার, আশীষ ভাই, ইউসুফ ভাই, নান্নু ভাই, মঞ্জু ভাই—ওনারা চট্টগ্রামে গেলেই আমাদের বাসায় যেতেন। প্রচুর খাওয়াদাওয়া হতো। তো আমি সব ছেড়ে ঢাকায় চলে এলাম। ঢাকায় অবশ্য ওনারা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। তবে ঢাকায় এসে আমার জীবন পুরোপুরি বদলে গেল। ঢাকায় খেলতে খারাপ লাগেনি, তবে একটা কথা কাউকে কখনো বলিনি—প্রথম প্রথম আমি অনেক কাঁদতাম। হোটেলে থাকতাম, খাওয়াদাওয়ার সমস্যা হতো। তবু খেলাটাকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম। অনেকে শুনে অবাক হবেন, জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার আগে আমি কিন্তু কখনো বড় ক্লাবে খেলিনি। মনে আছে, রেলওয়েতে খেলে প্রথমবার দুই হাজার টাকা ও পরেরবার ছয় হাজার টাকা পেয়েছিলাম।
আপনার ব্যাপারে ভাবির জাজমেন্টগুলোকে খুব গুরুত্ব দেন মনে হয়...
আকরাম খান: অবশ্যই। অনেক সময় ওর অনেক কথায় আমি হঠাৎ অনেক খেপে যাই, কিন্তু পরে দেখা যায় যে সে-ই ঠিক ছিল। খেলোয়াড়ি জীবনের একটা ঘটনা বলি। গাড়ি চালিয়ে একবার ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাচ্ছি। তো কথা প্রসঙ্গে সে আমাকে বলল, ‘তুমি চিটাগং ক্লাবের মেম্বার হবা...।’ জানি না কে কীভাবে নেবেন, ক্লাবের মেম্বার হওয়াটাকে আমি তখন ভালো ভাবতাম না। ওর কথা শুনে আমি রেগে গিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতেই জানালার গ্লাসে জোরে ঘুষি মারলাম, গ্লাস ফেটে গেল। আমার রাগ দেখে সে কেঁদে দিয়েছিল। পরে আমি ঠিকই মাত্র ২০ হাজার টাকায় ক্লাবের মেম্বার হয়েছি, যেটাতে আমার অনেক উপকার হয়েছে। পরে বুঝেছি, ক্লাবের মেম্বার হওয়াটা খারাপ কিছু নয়। খাওয়ার কথা বলি। আমি আগে মাছ খেতাম না। মাংসই ছিল আমার পছন্দ। মাছ যে এত মজার জিনিস, অনেক বছর পর্যন্ত আমি সেটা জানতাম না। এটা ঝোল দিয়ে রান্না হতে পারে, সে ধারণাও ছিল না। আমার পছন্দের খাবার এখনো যদিও পরোটা-মাংস, তবে এখন সেটা অনেক নিয়ন্ত্রিত। ঢাকায় আসার পর থেকে আমার স্ত্রী–ই আমাকে খাওয়া কন্ট্রোল করতে উৎসাহ দেয়। সে–ই আমাকে মাছ খাওয়া শিখিয়েছে। জীবনে এত খেয়েও আল্লাহর রহমতে এখন পর্যন্ত তো সুস্থ আছি। এ রকম অনেক কিছু...পরিবার, ব্যবসা, বাচ্চাদের পড়াশোনা—বেশির ভাগই ওর পরিকল্পনা থেকে হয়েছে। বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য ঢাকায় এলে ভালো হবে, এটা আমার মাথায় আসেনি কখনো। ওদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, এগুলো সে–ই করেছে। আমি বিশ্বাস করি, ভালো বউ পাওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার।
- ট্যাগ:
- খেলা
- ক্যারিয়ার
- ব্যক্তি জীবন
- আকরাম খান