
টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স: অনিয়মই যেখানে নিয়ম
বাংলাদেশে টেলিভিশনের লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া কখনোই স্বচ্ছ ও উন্মুক্ত ছিল না। বেসরকারি খাতের প্রথম টেলিভিশনের লাইসেন্স নিয়ে যে বিতর্কের শুরু হয়েছিল, তা আজও চলমান। যোগ্যতা ও পেশাদারত্বের প্রমাণ দিয়ে লাইসেন্স পেতে হয়নি। দলীয় আনুগত্য, স্বজনপ্রীতি, ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং কিছু ক্ষেত্রে হয়তো নগদ নারায়ণই ছিল মুখ্য।
এটি ক্রমাগত বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিসরকে দলবাজ, অযোগ্য, অপেশাদার ও সুযোগসন্ধানীদের কুক্ষিগত করতে সাহায্য করেছে—যারা সর্বদা এক পা খাড়া করে প্রভুদের তুষ্ট করতে উদগ্রীব ছিলেন বা এখনও আছেন। গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা ও নাগরিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনের ওপর এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ২০২৪ সালের জুলাই–অগাস্টের গণআন্দোলনের সময়। ওই উত্তাল দিনগুলোতে অধিকাংশ টেলিভিশন চ্যানেল শুধু রাষ্ট্রীয় সম্পদের ধ্বংসযজ্ঞই দেখতে পেয়েছে এবং বারবার দেখিয়েছে আমাদেরকে। রাজপথে ছাত্র-জনতার রক্তস্রোতে দাঁড়িয়ে স্থাপনার জন্য কেঁদে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন তাদের সংবাদকর্মীরা।
গণতন্ত্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। গণমাধ্যমের একটি সহজাত প্রভাবক ক্ষমতা রয়েছে, যা মানুষের মতামত ও মনোভাবকে প্রভাবিত করে, প্রতিক্রিয়া তৈরিতে প্ররোচিত করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এই যুগে ওই প্রভাব কিছুটা কমলেও টেলিভিশনের আবেদন ও অবদান যে নিঃশেষ হয়ে গেছে, তা বলা যায় না। যে কারণে ২০২৫ সালে কামাল আহমদের নেতৃত্বাধীন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, বেসরকারি মালিকানায় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর লাইসেন্সের আবেদন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অনাপত্তিপত্র ও লাইসেন্সধারীদের অঙ্গীকারনামা পর্যালোচনা করে স্পষ্ট হয় যে, এসব লাইসেন্স প্রদানে কোনো উন্মুক্ত ও স্বচ্ছ প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি অনুসৃত হয়নি। প্রধানত রাজনৈতিক বিবেচনা ও কিছুটা ব্যবসায়িক পরিচিতির ভিত্তিতেই এসব লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। (সুপারিশমালা: ২১.৫.১, বাংলাদেশে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন: ২০২৫, পৃ. ১৪৭)
সংস্কার কমিশনের এই সুপারিশমালায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, দেশের স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের অনুমোদন প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ও মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ। গণমাধ্যমের অবাধ বিকাশের স্বার্থেই এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। যে লক্ষ্যে কমিশন সুপারিশ করেছে যে, সম্প্রচার নীতিমালায় সম্প্রচার কমিশন গঠনের কথা বলা আছে এবং সম্প্রচার লাইসেন্স প্রদানের বিষয়ে সুপারিশ করার দায়িত্ব সম্প্রচার কমিশনের এবং যেহেতু গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গণমাধ্যমের সব বিষয় অর্থাৎ সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও ও অনলাইনের জন্য বিদ্যমান প্রেস কাউন্সিল ও প্রস্তাবিত সম্প্রচার কমিশনের দায়িত্ব ও ক্ষমতার সমন্বয়ে গণমাধ্যম কমিশনের সুপারিশ করা হয়েছে, সেহেতু বেসরকারি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্সসমূহ পর্যালোচনার দায়িত্ব গণমাধ্যম কমিশনই পালন করবে। (সুপারিশমালা: ২১.৫.১, বাংলাদেশে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন প্রতিবেদন: ২০২৫, পৃ. ১৪৭-১৪৮)
একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে সৃজনশীলতা, গতিময়তা, জবাবদিহিতা ও শৃঙ্খলা আনার উদ্দেশ্যে এবং দুটি প্রতিষ্ঠানকে স্বায়ত্তশাসন প্রদানের নীতিমালা তৈরিতে ১৯৯৬ সালে সাবেক সচিব মোহাম্মদ আসাফ্উদ্দৌলাহ্র নেতৃত্বে ১৬ সদস্যের একটি কমিশন গঠিত হয়েছিল। যে কমিশনের প্রথম সুপারিশ ছিল দেশের সম্প্রচার মাধ্যমকে যথাযথ ধারায় প্রবাহিত করার জন্য জাতীয় সম্প্রচার কমিশন গঠন করা; যার অন্যতম দায়িত্ব হবে বেসরকারি চ্যানেলের জন্য লাইসেন্স প্রদান করা। খেয়াল করুন, এই সুপারিশ করা হয়েছিল আজ থেকে ২৮ বছর আগে, ১৯৯৭ সালে। যে সুপারিশের দিকগুলো বাস্তবায়নে পরবর্তীকালে কোনো সরকারই আগ্রহ দেখায়নি।
বর্তমানে ফেরা যাক। রক্তাক্ত জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার অনেক আগ্রহ ও উৎসাহ নিয়ে গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনসহ মোট ১১টি কমিশন গঠন করেছিল। ২০২৫ সালের ২২ মার্চ গণমাধ্যম কমিশনের প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর অনেকেই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর পদক্ষেপের। বিশেষ প্রত্যাশা ছিল, গণমাধ্যম পরিসরকে দলীয় আনুগত্য, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতিবাজ ও সুযোগসন্ধানীদের হাত থেকে মুক্ত করে এই সরকার একটি সুষ্ঠু, প্রতিযোগিতামূলক, উন্মুক্ত ও সুষম পরিবেশ তৈরি করবে। কিন্তু ওই আশায় গুঁড়েবালি।
- ট্যাগ:
- মতামত
- লাইসেন্স
- অনিয়ম
- টিভি চ্যানেল