
অসময় এবং অসহায় অর্থনীতিবিদ
এক মহিলা তার ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারলেন যে, তিনি আর মাত্র ছ’মাস বাঁচবেন। ডাক্তার তাকে এও উপদেশ দিলেন এরিমধ্যে তিনি যেন একজন অর্থনীতিবিদকে বিয়ে করেন।
মহিলাঃ “ওতে কি আমার অসুস্থতা দূর হয়ে যাবে ডাক্তার?”
ডাক্তারঃ “না, তবে ছ’মাস মনে হবে অনেক লম্বা সময়।”
এক.
সরকারবিরোধী সমালোচকদের ধারণা, এদেশে গণতন্ত্র আর বিতর্কের পরিবেশ ক্রমান্বয়ে কুঞ্চিত হয়ে পড়েছে; সংলাপের পথ রুদ্ধ প্রায়। অবস্থা নাকি হয় তুমি নয় আমি। তবে ‘ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’ এমনটি নিশ্চিত নন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ ব্যানার্জি ও এস্থার ডাফলো- “আমরা বর্তমানে বাস করছি এমন একটা যুগে যখন মেরুকরণ বেড়েই চলেছে। হাঙ্গেরি থেকে ভারত, ফিলিপিন্স থেকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন থেকে ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া থেকে ইতালি সবখানে ডান ও বামের সংলাপগুলো উচ্চতর ধ্বনি সমৃদ্ধ দীর্ঘ পারস্পরিক গালিগালাজ; অব্যাহতভাবে ছোড়া কর্কশ শব্দ অতিক্রান্ত পথ ধরে ফিরে আসার সুযোগ দেয় খুব কম।”
গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে খ্যাত খোদ মার্কিন মুল্লকের কথা ধরা যাক। ওই দেশে যারা কোনো একটা বিশেষ দলের সমর্থক আছেন, তাদের প্রায় আশি ভাগ নাকি অন্য দলের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। যেমন, ডেমোক্রেট সমর্থকদের প্রায় দুই- তৃতীয়াংশ মনে করেন রিপাবলিকানরা সাম্প্রদায়িক, গোঁড়া এবং যৌনবৈষম্যবাদী। আবার, অর্ধেকেরও কিঞ্চিৎ বেশি রিপাবলিকানের বদ্ধমূল বিশ্বাস যে ডেমোক্র্যাটরা বিদ্বেষপূর্ণ। মজার ব্যাপার হল, সমগ্র মার্কিনিদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হতাশ হয় যখন পরিবারের ঘনিষ্ঠ একজন সদস্য অন্য পক্ষের কাউকে বিয়ে করে। সুতরাং, গণতন্ত্র ও বিতর্কের উপর নির্মিত সভ্যতা, হোক তা ফ্রান্স কিংবা ভারতে– এখন যে হুমকির মুখে তা বলাই বাহুল্য বলে মনে করেন নোবেলজয়ী স্বামী-স্ত্রী।
দুই.
অভিজিৎ ও এস্থার মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীদের কাজ হচ্ছে ঘটনা উপস্থাপন করা এবং ঘটনার যথাযথ ব্যাখ্যা দেয়া। এটা ঘটলে বিদ্যমান বিভাজন প্রশমিত হবার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। প্রত্যেক পক্ষকে বোঝানো অপরপক্ষ কী বলছে এমন প্রক্রিয়া ঐকমত্য না হলেও কিছুটা যৌক্তিক ভিন্নমত পোষণে সাহায্য করবে বলে বিশ্বাস। মনে রাখা দরকার যে, যদি উভয় পক্ষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকে তাহলে মতদ্বৈততার মাঝেও গণতন্ত্র বাস করতে পারে। কিন্তু শ্রদ্ধা সৃষ্টির পূর্বশর্ত হচ্ছে খানিক বোঝাপড়া- যা নেই বলেই যত সমস্যা। বর্তমান অবস্থাকে বিশেষ উদ্বিগ্ন ভাবার কারণ সংলাপের জায়গাটুকু সংকুচিত হয়ে আসছে।
শুধু রাজনীতি নিয়ে নয়, এমনকি মূল সামাজিক সমস্যা শনাক্তকরণ এবং সমাধানের পথ খোঁজার মধ্যেও এক ধরনের গোত্রীয় মনোভাব (tribalization of views) লক্ষণীয়। একটা বড় সমীক্ষায় দেখা যায়, বিস্তৃত বিষয়ের উপর দেয়া মতামতগুলো আঙুরের গুচ্ছের মতো একত্রে আসতে থাকে। যেমন, যারা মূল কিছু বিশ্বাসে অংশীদার তারা বিভিন্ন ইস্যুতে একই মতামত নিয়ে আসেন– হোক সে অভিবাসন, আয়-বৈষম্য কিংবা সরকারের ভূমিকা বিষয়ক। নীতিমালার ক্ষেত্রে তাদের অভিমত প্রকাশে বেশি প্রাধান্য পায় এই মূল বিশ্বাসগুলো- কোথায় তারা বাস করে, তাদের আয় অথবা তাদের জনমিতিক বৈশিষ্ট্যে পড়ে থাকে পেছনে।
তিন.
তবে স্বীকার করতেই হয় যে, এই প্রবণতা বেশ ধ্বংসাত্মক বিশেষত যখন আমরা দুঃসময়ে পড়েছি(যেমন আপাতত বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো )। বাণিজ্য বিস্তৃতি এবং চিনের চিত্তাকর্ষক অর্থনৈতিক সাফল্যের ফলশ্রুতিতে লব্ধ বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির রমরমা অবস্থা এখন আর আগের মতো নেই, এবং সবজায়গায় বাণিজ্য যুদ্ধ এবং চিনের শ্লথ প্রবৃদ্ধির কারণে হয়তো সেই দিন সমাপ্ত প্রায়। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার যে-সব দেশ স্ফীত স্রোতে সমৃদ্ধিশালী হয়েছিল তারা এখন ভাবছে তাদের জন্য এরপর কী অপেক্ষা করছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সরকারের সমালোচনা
- অর্থনীতিবিদ