
ডিজিটালাইজড বিচার বিভাগের সন্ধানে
বর্তমান বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে জনমুখী ও সেবাধর্মী করতে প্রয়োজন প্রাচীন ঔপনিবেশিক ধাঁচের বিচারব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা। এ জন্য দরকার আদালতের সব জায়গায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। এটা করা গেলে নাগরিকদের আদালতকেন্দ্রিক পরিষেবা সুলভে, স্বল্প সময়ে এবং স্বচ্ছতার মাধ্যমে প্রদান করা সম্ভব হবে। আদালতের কাজে আইনি প্রযুক্তির উপযোগিতা ইতিমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিচারব্যবস্থায় সফলভাবে প্রমাণিত হয়েছে এবং প্রযুক্তির ব্যবহার এখন আধুনিক বিচারব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
২০২০ সালে দুনিয়াব্যাপী করোনার সময় লকডাউনের কারণে যখন আদালতব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল; তখন মহামারিসংক্রান্ত বিধিনিষেধ মোকাবিলায় প্রযুক্তির ব্যাপক প্রয়োগ ন্যায়বিচার নিশ্চিতে এবং আদালতে মামলা পরিচালনার প্রতিবন্ধকতাগুলো উত্তরণে নতুন দরজা উন্মোচিত করেছিল। যদিও মহামারি-উত্তর সময়ে বাংলাদেশে এ-সংক্রান্ত অগ্রগতি আর খুব একটা পরিলক্ষিত হয়নি।
বর্তমানে বিচার বিভাগে আইনি প্রযুক্তির সীমিত ব্যবহার রয়েছে। যেমন সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে উচ্চ আদালতের মামলার প্রাত্যহিক কার্যতালিকা (কজলিস্ট), মামলার রায় ও আদেশ, বিভিন্ন প্রশাসনিক বিজ্ঞপ্তি, আদেশ ও সার্কুলার নিয়মিত প্রকাশ, মামলা অনুসন্ধান ইত্যাদি ব্যবস্থা রয়েছে। তবে সুপ্রিম কোর্টের কজলিস্ট কাগজেও নিয়মিত ছাপা হচ্ছে এবং আইনজীবীরা অভ্যাসগত কারণে ই-কজলিস্টের তুলনায় কাগজে ছাপানো কজলিস্ট বেশি পছন্দ ও ব্যবহার করছেন। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও পরিবেশ রক্ষায় সংবেদনশীল হতে চাইলে আদালতে কাগজের ব্যবহার সীমিত করে ই-কজলিস্ট, ই-ফাইলিং, ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে সমন প্রেরণের ব্যবস্থা গ্রহণ ও অন্যান্য কাজে ই-নথির বাধ্যতামূলক ব্যবহারের দিকে দ্রুত মনোযোগ বাড়াতে হবে।
এ ছাড়া আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ আইন ও বিচার বিভাগের ওয়েবসাইটে অধস্তন আদালতের বিচারকদের বদলি, পদোন্নতি, বিভিন্ন নির্দেশনা-সংবলিত বিজ্ঞপ্তি প্রভৃতি প্রকাশ করা হয়। পাশাপাশি এটুআই প্রকল্পের আওতায় সব অধস্তন আদালতের জন্য একটি ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে ই-কজলিস্ট প্রচার, অধস্তন আদালতের রায় ও সিদ্ধান্ত প্রকাশের জন্য একটি আলাদা ওয়েবসাইট, অধস্তন আদালত থেকে তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণের জন্য একটি অনলাইন পর্যবেক্ষণ প্ল্যাটফর্ম, জামিন নিশ্চিতের জন্য ‘বেইল কনফার্মেশন অনলাইন ম্যানুয়াল’, বিচারকদের জন্য একটি অনলাইন জ্ঞানভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদির ব্যবস্থা রয়েছে। তা ছাড়া, মাই কোর্ট অ্যাপ, উত্তরাধিকার ক্যালকুলেটর, জুডিপে, ই-ফাইলিং, ই-সার্টিফায়েড কপি ইত্যাদি-সংবলিত বিচারিক পরিষেবা সম্পর্কিত তথ্য প্রদানের জন্য একটি ভিন্ন প্ল্যাটফর্মও রয়েছে।
তবে বিচার বিভাগকে আধুনিক ও ডিজিটাইজড করার লক্ষ্যে উল্লিখিত প্রচেষ্টাগুলো প্রশংসনীয় হলেও এর বেশ কিছু উদ্যোগ এখন নানাবিধ সীমাবদ্ধতা নিয়ে চলছে। কিছু উদ্যোগ প্রকল্পভিত্তিক হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ শেষে এখন আর কার্যকর নেই এবং কিছু উদ্যোগ বিরাজমান বাধা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পর্যাপ্ত নয়।
২০২৫ সালের শুরুতে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ হোয়াটসঅ্যাপভিত্তিক স্লিপ গ্রহণ ব্যবস্থা চালু করেছে। এই নতুন ব্যবস্থার আওতায় আপাতত মোশন ও সময় বৃদ্ধিসংক্রান্ত শুনানির আবেদনপত্র স্ক্যান করে একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে পাঠাতে হবে এবং সেখান থেকে আইনজীবীদের আবেদনগুলো গৃহীত হবে। তবে আদালতের কাজের মতো আনুষ্ঠানিক আইনি প্রক্রিয়ায় হোয়াটসঅ্যাপের মতো অনানুষ্ঠানিক পদ্ধতি ব্যবহারে নিরাপত্তাসহ নানাবিধ ঝুঁকি রয়েছে। তাই সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে অথবা ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে অনলাইনভিত্তিক বাধ্যতামূলক ফাইলিং সিস্টেম চালু করতে পারলে আদালতের নথি ব্যবস্থাপনা, মামলা পরিচালনা, রায় লেখা ও প্রদান, মামলাসংক্রান্ত তথ্য আদান-প্রদান, বিচারপ্রার্থীকে মামলার তথ্য অবগতকরণসহ নানা ক্ষেত্রে জনবান্ধব এবং আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব।
অপরদিকে বছরের প্রারম্ভে হাইকোর্টের ভিন্ন আরেকটি বেঞ্চ মামলা পরিচালনায় কাগজবিহীন ব্যবস্থা প্রচলন করেছেন। তবে এ ব্যবস্থাও এখন পর্যন্ত পুরোপুরি কাগজমুক্ত নয়। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে মামলার নথি আপলোডের নিশ্চয়তার কপি প্রিন্ট করে একটি হলফনামাসহ আদালতে দাখিল করতে হয়। ফলে এখানে এখন একটি মিশ্র পদ্ধতি চালু রয়েছে, যা আইনি প্রযুক্তির মাধ্যমে পুরোপুরি ডিজিটাল বা কাগজবিহীন করা সম্ভব।
এ ছাড়া সম্প্রতি মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ সংশোধনপূর্বক মুসলিম বিবাহ ও তালাক অনলাইনে নিবন্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে অনলাইনে বিবাহ ও তালাক সনদ সংগ্রহ, তথ্য সন্ধান, দূতাবাস বা বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক সনদ যাচাই সহজে সম্ভব হবে এবং বাল্যবিবাহ নিরোধ এবং অন্যান্য ভোগান্তি লাঘবে অনলাইনব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থা