
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচিগুলোর মূল লক্ষ্য হলো, সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে রক্ষা করা। কিন্তু জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার বড়তারা ইউনিয়নের ভিডব্লিউবি (ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট) কর্মসূচির তালিকা প্রণয়নের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা এই কর্মসূচির উদ্দেশ্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সামাজিক সুরক্ষার কর্মসূচিগুলো নিয়ে আগেও এমন অনেক অনিয়ম দেখা গেছে। এমন অনিয়মের ধারাবাহিকতা সত্যিই দুঃখজনক।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, বড়তারা ইউনিয়নের ভিডব্লিউবি তালিকার সুবিধাভোগী স্বপ্না খাতুনের পরিবারে পাকা বাড়ি, গরু ও ইজিবাইক সবই আছে। অথচ তাঁর বাড়ির সামনেই ভাঙাচোরা মাটির ঘরে বসবাসকারী দিনমজুর হালিমা খাতুনের মতো প্রকৃত দুস্থদের নাম তালিকায় ওঠেনি। ভিডব্লিউবি কর্মসূচির প্রধান উদ্দেশ্য দরিদ্র মহিলাদের দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করা—কিন্তু যখন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান ও সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের সদস্যদের স্বজনপ্রীতি ও ঘুষের মাধ্যমে সচ্ছল পরিবারের সদস্যরা এই সুবিধা লুফে নেন, তখন সরকারের দেওয়া ৩০ কেজি চাল যেন গরিবের প্রাপ্য অধিকারের প্রতি চরম উপহাস হয়ে দাঁড়ায়।
তালিকায় ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলামের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী, চাচি ও ভাইয়ের স্ত্রীর মতো একাধিক আত্মীয়ের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়া স্বজনপ্রীতির সুস্পষ্ট প্রমাণ। যদিও ইউপি সদস্যের যুক্তি, ‘আত্মীয়স্বজন যদি পাওয়ার যোগ্য হয়, তাহলে পাবে না কেন?’ সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই তালিকা তিনজন কর্মকর্তা প্রকাশ্যে যাচাই-বাছাই করে তৈরি করেছিলেন। এত কিছুর পরও যদি পাকা বাড়ি ও ব্যবসার মালিকদের নাম তালিকায় স্থান পায়, তবে প্রশ্ন ওঠে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া কি লোকদেখানো ছিল? ইউপি সদস্য, প্যানেল চেয়ারম্যান ও মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ের কর্মচারীদের মধ্যে কোনো যোগসাজশ ছিল না তো?
যাঁরা নীতিমালার অপব্যবহার করে দরিদ্রদের অধিকার কেড়ে নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। অভিযোগ ওঠার পর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা যেন কোনোভাবেই লোকদেখানো না হয়।
এ সমস্যা শুধু জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলায় নয়, দেশের অনেক অঞ্চলে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা বিতরণে একই ধরনের অনিয়ম ঘটে। এই সংকট দূর করতে হলে তালিকা প্রণয়নের প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও পাবলিক প্ল্যাটফর্মে উন্মুক্ত করতে হবে, যাতে যেকোনো নাগরিক সহজেই যাচাই করতে পারেন। তালিকা প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইউপি সদস্যদের একক ক্ষমতা সীমিত করে সমাজের প্রকৃত দুস্থদের নিয়ে কাজ করা এনজিও বা নিরপেক্ষ কমিটিকে যাচাই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে। জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ইউপি সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সুবিধা প্রকৃত দুস্থদের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করার বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না, সেটিই কাম্য।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সামাজিক সুরক্ষা
- স্বজনপ্রীতি