দেশভাগের ভেতর-বাহির

www.ajkerpatrika.com সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশিত: ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৩:১৮

১৯০৫ থেকে ১৯৪৭—এই সময়কালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রধান ধারাটি ছিল জাতীয়তাবাদী; তবে জাতীয়তাবাদের ভেতর ভয়ংকরভাবে প্রবেশ ঘটেছিল সাম্প্রদায়িকতার, ফলে স্বাধীনতার সংগ্রাম বিভক্ত হয়ে গেছে, এবং যে মুক্তি স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল, সেটি অর্জিত হয়নি। মুক্তির অর্থ ছিল ধর্ম, শ্রেণি ও বর্ণনির্বিশেষে সব ভারতবাসীর মুক্তি। একদিকে ভারতবর্ষের মানুষের তুমুল আন্দোলন, অপরদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নিজেদের দুর্দশা এবং আন্তর্জাতিক (বিশেষভাবে উত্থানে-উন্মুখ আমেরিকার) চাপ ও হিটলারকে পরাভূত করার ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপুল সাফল্য—এসব কারণে ব্রিটিশ শাসকেরা বুঝতে পারছিল, ভারতবর্ষে আর থাকা যাবে না। তারা ঠিক করে, ক্ষমতা হস্তান্তর করবে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের হাতে। বলা বাহুল্য, প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ওই দুই রাজনৈতিক দল সৃষ্টির পেছনে ব্রিটিশের উৎসাহ দান ছিল প্রত্যক্ষ। দল দুটির নেতৃত্বে ছিল যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি, সেটিও গড়ে উঠেছিল ব্রিটিশ শাসকদের আনুকূল্যেই।


বড় আকারে ব্রিটিশবিরোধী প্রথম অভ্যুত্থানটি ঘটে ১৮৫৭ সালে। সিপাহিরা ছিল সেই অভ্যুত্থানের মূল শক্তি, তবে দেশীয় শাসকেরাও কেউ কেউ যুক্ত হয়েছিলেন। এর আগে ও পরে বিক্ষিপ্ত আকারে বিদ্রোহ ঘটেছে, ফকির ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য; কিন্তু ব্রিটিশ ভারতব্যাপী কোনো অভ্যুত্থান ঘটেনি। ১৮৫৭-এর অভ্যুত্থানে ব্রিটিশের টনক নড়ল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে দখল করা ভারতবর্ষকে সরাসরি ব্রিটিশ শাসনে নিয়ে গিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অংশ করে ফেলা হলো। আর অভ্যন্তরে সদ্য গঠিত মধ্যবিত্তকে উৎসাহিত করা হলো একটি রাজনৈতিক দল গঠনে। এর পেছনে কারণ ছিল দুটি। প্রথম কারণ, মধ্যবিত্তকে ক্ষোভ প্রকাশ এবং আবেদন-নিবেদন জানানোর জন্য একটা বন্দোবস্ত করে দেওয়া। দ্বিতীয় কারণ, ভবিষ্যতের কোনো অভ্যুত্থানে মধ্যবিত্ত যাতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যুক্ত না হয়ে পড়ে, সেটা নিশ্চিত করা। সিপাহি অভ্যুত্থানে মধ্যবিত্ত যোগ তো দেয়ইনি, উল্টো বিরোধিতাই করেছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের ভেতর অসন্তোষ দেখা দিচ্ছিল। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক দল গঠনে উদ্যোগী হয়ে উঠছিলেন; তাঁদের উদ্যোগের পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নেওয়াটাও আবশ্যক ছিল।


ব্রিটিশের আনুকূল্যেই তাই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হলো। কিন্তু তাতেও দেখা গেল ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না। ব্রিটিশ শাসকেরা তখন তাদের ব্যবহৃত ‘ভাগ করো এবং শাসন করো’ নীতি প্রয়োগ করে ভারতবর্ষের মুসলমানদের উৎসাহ দেয় স্বতন্ত্র একটি দল গঠনে। ফলে গঠিত হলো সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ। এর আগে আদমশুমারিতে হিন্দু ও মুসলমানদের স্বতন্ত্রভাবে দেখানো হয়েছে, এমনকি ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও হিন্দু যুগ এবং মুসলমান যুগ নামে কৃত্রিম যুগ বিভাজন খাড়া করা হয়েছে; ‘ভাগ করো ও শাসন করো’ নীতি প্রয়োগের ধারাবাহিকতাতেই ব্যবস্থা করা হলো পৃথক নির্বাচনের। নির্বাচনে ভোটাধিকার ছিল শতকরা মাত্র দুজনের; নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা বলতে কিছুই ছিল না। চাপের মুখে ছাড় দিয়ে শাসকেরা নির্বাচনের ব্যবস্থা করল বটে, তবে স্থির করে দিল যে হিন্দুরা ভোট দেবে হিন্দুদেরকে, মুসলমানরা মুসলমানদের। ওই ব্যবস্থা ১৯৪৬-এর নির্বাচন পর্যন্ত চালু রাখা হয়েছিল। ভোটাধিকার বেড়েছিল সামান্য, মাত্র ১২ শতাংশ পর্যন্ত; তবে হিন্দু-মুসলমান যে একসঙ্গে ভোট দেবে, এমন সুযোগ ছিল না।


ব্রিটিশ আগমনের আগপর্যন্ত উপমহাদেশে সম্প্রদায় ছিল ঠিকই, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। সাম্প্রদায়িকতা ব্রিটিশ শাসনের সৃষ্টি। হিন্দুরা ছিল সংখ্যায় বেশি এবং তাদের আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠাও ছিল অধিকতর শক্তিশালী, কিন্তু মুসলমানরাও সংখ্যায় কম ছিল না, জনসংখ্যায় তারা ছিল এক-চতুর্থাংশ, এবং একসময় তারা ভারতবর্ষকে শাসনও করেছে। কাজেই দুই সম্প্রদায়ের ভেতর রেষারেষিটা যে অস্বাভাবিক ছিল, এমনটা বলা যাবে না; কিন্তু তাকে তীব্র বিরোধিতায় পরিণত করা এবং সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেওয়ার কাজটা মূলত ব্রিটিশরাই করেছে।


ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত করার আন্দোলনে জাতীয়তাবাদীরা ছিলেন, সমাজতন্ত্রীরাও ছিলেন। কিন্তু জাতীয়তাবাদীদের আর্থসামাজিক শক্তিটা ছিল বেশি, তদুপরি আন্দোলন যাতে কিছুতেই সমাজতন্ত্রীদের হাতে চলে না যায় এবং রাশিয়ার মতো কোনো বিপ্লব যাতে ভারতবর্ষে না ঘটে, তার ব্যবস্থা করার জন্য পুঁজিবাদী বিশ্ব জাতীয়তাবাদীদেরই সমর্থন দিত, দমন করতে চাইত সমাজতন্ত্রীদের। সে জন্য ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব জাতীয়তাবাদীদের হাতেই রয়ে গেল এবং জাতীয়তাবাদীরা হিন্দু-মুসলমান—দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে সংঘর্ষ বাধিয়ে ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা প্রাপ্তির নামে দেশভাগের মতো মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি ঘটাল। আধুনিককালে ভারতবর্ষের প্রথম ট্র্যাজেডি ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা, দ্বিতীয় ট্র্যাজেডি ১৯৪৭-এ দেশভাগ।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও