
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন : সংকট ও সমাধান
তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে ভারত তিস্তা-পানি চুক্তি না করে ন্যায্য প্রাপ্য পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে আসছে। বিগত সরকার বহু চেষ্টা করেও ভারতের বাধার কারণে তিস্তা প্রকল্প একনেকে পাশ করার পরও বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশবাসী তা বাস্তবায়নরূপে দেখার অপেক্ষায় আছে।
স্বাধীনতার ৫০ বছরে এসে ভারত থেকে আমাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হওয়ার সংবাদটি সব মহলে তুমুলভাবে আলোচিত। বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিস্তা চুক্তির বিষয় যুবসমাজকে চরমভাবে ব্যথিত করেছে, জাগ্রত করেছে।
তিস্তা নদী নিয়ে ‘কম্প্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন অব তিস্তা রিভার প্রজেক্ট’ বা তিস্তা নদীর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প নামে একটি পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এটি তিস্তা মহাপরিকল্পনা নামেও পরিচিত। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে চীন ও ভারত-দুই দেশই বিভিন্ন সময়ে আগ্রহ দেখিয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসের শুরুতে বাংলাদেশ সফরে এসে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়েত্রা তিস্তা প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারও চেয়েছিল, প্রকল্পটিতে যেন ভারত অর্থায়ন করে।
গ্রীষ্মে পানিহীনতা, বর্ষায় ভাঙন
তিস্তা বাংলাদেশ-ভারতের অভিন্ন নদী। এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। ভারত তার অংশে বাঁধ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করছে। একদিকে ভারতের পানি প্রত্যাহার, অন্যদিকে ভাঙনে দুই কারণে বাংলাদেশ অংশে নদীটির তীরবর্তী মানুষের জীবন-জীবিকা ও বসতি হুমকিতে পড়েছে।
তিস্তায় প্রয়োজনের সময় পানি না পাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরের দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না বলে মত বিশেষজ্ঞদের। গত জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দারিদ্র্যের যে মানচিত্র প্রকাশ করেছে, তাতে উত্তরাঞ্চলের এসব জেলার এই হার তুলনামূলক বেশি বলে উঠে আসে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য ১১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪৫ কিলোমিটার ভাঙনপ্রবণ। বিশেষ করে প্রায় ২০ কিলোমিটারে পরিস্থিতি ভয়াবহ। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলা অংশে টানা ভাঙন হয়। ভাঙন আছে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধায়ও। ভাঙন প্রতিরোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।
পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত ২৮ জুলাই বলেছেন, তিন কারণে বাংলাদেশে তিস্তা প্রকল্পটি খুবই দরকার। এক. বর্ষার সময় তিস্তা অববাহিকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা। দুই. বর্ষার আগে-পরে নদীর ভাঙন কমানো। তিন. শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানির প্রবাহ বাড়ানো। তিনি বলেন, ‘কারিগরি দিক দিয়ে জটিল এ প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশীজনদের সঙ্গে পরামর্শক সভা করার কথা ছিল। তবে সেটা হয়েছে বলে শুনিনি। অন্তত আমাকে কেউ ডাকেনি। হয়তো আমাকে উপযুক্ত মনে করেনি।’
আইনুন নিশাত বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচুর টাকা দরকার। যারা এগিয়ে আসবে, সরকার সব দিক বিবেচনায় তাদের কাছ থেকেই ঋণ নেবে। চীন শুধু অর্থ নয়, প্রযুক্তি নিয়ে আসবে। তবে তিনি মনে করেন, তিস্তা প্রকল্পে চীন যে কোনো ধরনের কারিগরি কাজ করুক না কেন, ভারত না দিলে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানিপ্রবাহ বাড়বে না। ভারতের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে এর সমাধান করতে হবে।
তিস্তা প্রকল্পটির দিকে নজর রাখছে ভারতও। শিলিগুড়ি করিডরে হওয়ায় ওই এলাকাটি খুবই স্পর্শকাতর। ভারত ওই অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি চায় না।
এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, তিস্তা প্রকল্পটি বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রয়োজন। তিস্তা অববাহিকায় পানিপ্রবাহ না থাকায় মরুকরণ হচ্ছে। তবে শিলিগুড়ি করিডরে হওয়ায় ওই এলাকাটি খুবই স্পর্শকাতর। ভারত ওই অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি চায় না। চীনের ঋণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গেলে ভারতের পক্ষ থেকে বিরোধিতা আসবে। তিনি বলেন, এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত না নেওয়াটাই ভালো। নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে এসব প্রকল্পে হাত দেওয়া উচিত।
- ট্যাগ:
- মতামত
- তিস্তা প্রকল্প