দিল্লির সংকটকালে ভারতীয়-আমেরিকানদের বিস্ময়কর নীরবতা

www.ajkerpatrika.com শশী থারুর প্রকাশিত: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৯:১৬

আমেরিকায় অভিবাসীদের সাফল্যের কাহিনির ভান্ডারে ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকানদের গল্প আলাদা করে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গড় পারিবারিক আয় তাঁদের। ফরচুন-৫০০ কোম্পানির শীর্ষ পদে রয়েছেন একাধিক ভারতীয় বংশোদ্ভূত সিইও। মার্কিন কংগ্রেসে আছেন ছয়জন সদস্য, আছেন দুই সাবেক গভর্নর। এমনকি, এফবিআই ও সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মতো (সিডিসি) ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন বিভাগের উচ্চপদেও রয়েছেন অনেকে। সব মিলিয়ে ভারতীয়-আমেরিকানদের প্রভাব, সাফল্য আর মূলধারার সঙ্গে ভারতের স্বার্থ সুরক্ষার ধারণা বারবার সামনে উঠে এসেছে।


কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ভারতের বিরুদ্ধে একের পর এক কঠোর পদক্ষেপ নিলেও এ প্রভাবশালী প্রবাসী গোষ্ঠীর প্রতিক্রিয়া প্রায় নেই বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয় পণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে। এইচ-১বি ভিসার জন্য আবেদন ফি ১ লাখ ডলার করেছে, যে ভিসার ৭০ শতাংশই পান ভারতীয়রা। ইরানের চাবাহার বন্দরে ভারতের কৌশলগত উন্নয়ন প্রকল্পে দিয়েছে নিষেধাজ্ঞা। শিক্ষার্থী ভিসা ও অভিবাসনের পথও করেছে কঠিন। এমনকি নানাভাবে ভারতকে অপমানও করা হয়েছে। অথচ এসব ঘটনায় প্রবাসী ভারতীয়দের প্রতিবাদ শোনা যায়নি।

এই নীরবতা বিস্ময়কর! ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো বাধা নেই। ভারতীয়-আমেরিকানরা সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বোর্ড, থিঙ্কট্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁরা রাজনৈতিক প্রচারণায় অর্থ অনুদান দেন, সিনেটরদের পরামর্শ দেন, নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে সফরকালে কংগ্রেস সদস্যদের এক বৈঠকে এক মার্কিন প্রতিনিধি ভারতীয় এমপিদের জানিয়েছিলেন—তাঁর অফিসে ভারতের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পদক্ষেপ নিয়ে কোনো ফোনকলই আসেনি। অথচ ইসরায়েল ইস্যুতে তাঁর অফিসে অসংখ্য কল আসে নিয়মিত। তাহলে কেন ভারতের বিরুদ্ধে এমন শাস্তিমূলক পদক্ষেপের সময় প্রবাসীরা মুখ খোলেন না?

এর এক কারণ হয়তো দ্বৈত পরিচয়ের সূক্ষ্ম টানাপোড়েন। ভারতীয়-আমেরিকানরা, বিশেষ করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা, প্রায়ই হাঁটেন এক অদৃশ্য দড়ির ওপর। তাঁদের সাফল্য নির্ভর করছে একধরনের ভারসাম্যের ওপর—তাঁরা দীপাবলি উদ্‌যাপন করবেন, তবে খেয়াল রাখতে হয় যেন থ্যাঙ্কসগিভিং আড়ালে না পড়ে যায়। গান্ধীকে শ্রদ্ধা জানাবেন, তবে জেফারসনের ভাবমূর্তিকে আঘাত করবেন না। ভারতের পক্ষ নিয়ে জোরালোভাবে মুখ খোলা মানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকেই প্রকাশ্যে সমালোচনা করা। এতে প্রশ্ন উঠতে পারে—আপনার আনুগত্য আসলে কোথায়?


এই শঙ্কা অমূলক নয়। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীবিরোধী মনোভাব গত কয়েক বছরে ভয়াবহভাবে বেড়েছে। ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে মুসলিম নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে সীমান্তে ‘আক্রমণের’ কথিত আশঙ্কা—সব মিলিয়ে পরিবেশ আরও বৈরী হয়েছে বিদেশি হিসেবে দেখা হয়, এমন সব গোষ্ঠীর জন্য। অর্থনৈতিক সাফল্য সত্ত্বেও ভারতীয়-আমেরিকানরা এর বাইরে নন। তাঁরা দৃশ্যমান সংখ্যালঘু। দক্ষিণ এশীয়দের ওপর ঘৃণামূলক হামলা বেড়েছে। গায়ের রংকে বিদেশি হিসেবে দেখার প্রবণতা এখনো আছে। এমন পরিস্থিতিতে নীরবতা তাঁদের কাছে আত্মরক্ষার উপায় বলেই মনে হচ্ছে।


আমেরিকায় বসবাসরত ভারতীয়দের আতঙ্কের একটি বাস্তব দিকও রয়েছে। মার্কিন ভারতীয় বন্ধুদের অনেকে বলেন, যারা এক প্রজন্ম আগে সেখানে গিয়ে স্থায়ী হয়েছেন, তাঁরা এখন মনে করেন এইচ-১বি ভিসা তাঁদের সন্তানদের সুযোগ কেড়ে নিচ্ছে। নতুন করে পড়াশোনা শেষ করা অনেক স্টেম (বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়) গ্র্যাজুয়েট—এমনকি কম্পিউটার সায়েন্সে ডিগ্রিধারীরাও—বেকার হয়ে বসে আছেন। তাঁদের অনেকেই ভারতীয়-আমেরিকান। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো বেশি বেতনের মার্কিন কর্মীদের বাদ দিয়ে তুলনামূলক সুলভে পাওয়া এইচ-১বি ভিসাধারীদের কাজে লাগাতে চাচ্ছে। এ কারণে এসব পরিবারের কাছে নীরব থাকা মানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতিকে নীরব সমর্থন দেওয়া।


এই নীরবতার পেছনে প্রজন্মগত পার্থক্যও আছে। যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের ভারতীয়-আমেরিকানদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেকটাই ঢিলা। তাঁদের পরিচয় এখন দ্বৈত, আনুগত্যও বহুমুখী। তাঁদের কাছে ভারত মূলত পূর্বপুরুষের স্মৃতির জায়গা, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা নয়। তাঁরা হোলি উদ্‌যাপন করেন, ক্রিকেটের স্কোর অনুসরণ করেন বটে, কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক সচেতনতা বেশি মার্কিন দেশীয় বিষয় নিয়ে—পুলিশি নির্যাতন, বন্দুক-সহিংসতা বা জলবায়ু পরিবর্তন। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি তাঁদের আলোচনার কেন্দ্র হয় না।


এটা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং একধরনের পরিবর্তন। প্রবাসী পরিচয় এক জায়গায় থেমে থাকে না, সময়ের সঙ্গে বদলায়। তবে এর মানে দাঁড়ায়, যখন ভারত আঘাতের মুখে পড়ে, তখন তাঁদের প্রতিক্রিয়ার তাগিদও দুর্বল হয়। আবেগের টান কমে যায়, দায়িত্ববোধ হালকা হয়ে পড়ে। ইলন মাস্ক যেখানে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন, তিনি এইচ-১বি ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে লড়াই করবেন, তারপরও ভারতীয়-আমেরিকান সিইওরা মুখ খোলেননি।


কিন্তু এই নীরবতারও মূল্য আছে। প্রবাসীরা যদি ভারতের বিরুদ্ধে নেতিবাচক নীতি প্রয়োগের সময় প্রতিরোধ না গড়ে তোলেন, তবে তাঁরা নিজেদের নৈতিক অবস্থান হারান। এতে ভারতের বিষয়ে বিশ্বে ভুল ধারণা ছড়িয়ে পড়তে থাকে যে, ভারত যেন এক ‘বাণিজ্য প্রতারক’, এক ‘কৌশলগত ঝামেলার দেশ’ এবং এক ‘অবিশ্বস্ত অংশীদার।’ একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেই প্রবাসী গৌরবের গল্প, যা এত যত্নে তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রবাসীদের বলেছেন ‘রাষ্ট্রের দূত’, কিন্তু যদি সেই প্রতিনিধিত্ব বাস্তবে কোনো সমর্থনে না দাঁড়ায়, তবে তার মূল্য কোথায়?


তবুও নীরবতা একেবারে সর্বজনীন নয়। কিছু কণ্ঠস্বর শোনা গেছে—অ্যাকটিভিস্ট, শিক্ষাবিদ, কমিউনিটি নেতা আর কিছু রাজনীতিক, যেমন—নিকি হ্যালি ও রো খানা। কেউ ভিসা বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, কেউ আবার শুল্ক নীতির সমালোচনা করেছেন। তবে এগুলো বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ, অন্য প্রবাসী গোষ্ঠীর মতো সংগঠিত শক্তি হয়ে ওঠেনি। যেমন ইহুদি-আমেরিকানরা নিয়মিতভাবে ইসরায়েলের পক্ষে শক্তিশালী লবিং করেন। কিউবান-আমেরিকানরা দশকের পর দশক ধরে হাভানার বিরুদ্ধে মার্কিন নীতি গড়ে তুলেছেন। এর তুলনায় ভারতীয়-আমেরিকান সমাজ এখনো খণ্ডিত—অঞ্চল, ধর্ম আর রাজনৈতিক মতভেদের কারণে তাঁরা বিভক্ত হয়ে আছেন।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও