বইমেলা—এই শব্দটি উচ্চারণ করলেই আমাদের হৃদয়ে জেগে ওঠে এক গর্ব, এক ভালোবাসা, এক অমোঘ আবেগ। এটি শুধু একটি বই বিক্রির বিষয় নয়; এটি আমাদের ভাষা ও আত্মত্যাগের স্মারক, আমাদের সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, বাঙালির মননের মন্দির। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকে যে উৎসব শুরু হয়, তা হয়ে ওঠে এক মাসব্যাপী জাতীয় মহোৎসব।
কিন্তু এবারের বাস্তবতা ভিন্ন। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনায় বইমেলার অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হয়েছে। বইমেলা আদৌ হবে তো, কবে হবে? হবে কি ফেব্রুয়ারিতেই?—এই প্রশ্নগুলো ঘুরছে প্রকাশক, লেখক, পাঠক ও সাহিত্যপ্রেমীদের মনে। এই ধোঁয়াশা যেন এক অচেনা অস্থিরতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
বইমেলা মানেই একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষার মাস। এই মাসেই বইমেলার প্রতিটি পদচারণায় থাকে শহিদ মিনারের স্মৃতি, ভাষার জন্য রক্তদানের অহংকার, নতুন প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। তাই ফেব্রুয়ারির বাইরের কোনো সময়ে বইমেলা আয়োজন করলে সেটি কেবল একটি "বইয়ের মেলা" হয়ে থাকবে—হারাবে তার ঐতিহ্য, হারাবে "অমর একুশে"র চেতনা।
তবে বাস্তবতা যদি চাপিয়ে দেয় অন্য সময়ের বাধ্যবাধকতা, তাহলে প্রশ্ন জাগে—আমরা কি মেলাটিকে বাতিল করব? নিশ্চয়ই না।
বরং যেভাবেই হোক, প্রাণের মেলাকে বাঁচাতে হবে। আর এর জন্য করতে হবে বিকল্প চিন্তা, দৃঢ় সিদ্ধান্ত। বইমেলা স্থগিত করা নয়, বরং পরিকল্পিত রূপে রক্ষা করা এখন সবচেয়ে জরুরি। প্রয়োজনে ফেব্রুয়ারির শেষে বা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে বা আংশিকভাবে—যেভাবেই হোক, আয়োজন করতে হবে। মেলা সংক্ষিপ্ত হতে পারে, কিন্তু বাতিল হওয়া চলবে না। কারণ একবার মেলার ধারা ভেঙে গেলে, সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে। প্রকাশনা শিল্প, পাঠাভ্যাস, লেখকের মনোবল—সবকিছুই এই মেলার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। একটি বছরের ছেদ মানে অনেক স্বপ্নের মৃত্যু।
সংস্কৃতি কেবল প্রশাসনিক সময়সূচি দিয়ে নির্ধারিত হয় না। সংস্কৃতি জীবনের নিজস্ব ছন্দে প্রবাহিত হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব, সেই ছন্দকে রক্ষা করা। তাই নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনিক জটিলতার মধ্যে থেকেও একুশের মেলা টিকিয়ে রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, নীতি-নির্ধারণী স্পষ্টতায়, এবং সংস্কৃতিপ্রেমী সমাজের ঐক্যে।
অমর একুশে বইমেলা হারিয়ে গেলে হারাবে আমাদের চেতনার উৎস। যে মেলা আমাদের শেখায় চিন্তা করতে, ভালোবাসতে, ভাষাকে সম্মান করতে, ইতিহাসকে ধারণ করতে—সে মেলা যদি থেমে যায়, আমরা থেমে যাব ভিতরে ভিতরে। তাই আহ্বান—যেভাবেই হোক, যত বাধাই আসুক, প্রাণের মেলা যেন হারিয়ে না যায়। এই মেলা আমাদের আত্মার উৎসব। এই মেলা বাঁচলে, বাঁচবে আমাদের মনন, বাঁচবে ভাষা, বাঁচবে বাংলাদেশ।