দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় আচার নয়; এটি আনন্দ, মিলন আর প্রাণের উৎসব যেমন, তেমনই অর্থনীতিরও প্রাণস্পন্দন বটে। উৎসবের আবহে ধর্ম-নির্বিশেষে সবার জন্য খুলে যায় ব্যবসা-বাণিজ্যের নতুন দিগন্ত—শিশুর চোখে নতুন জামার স্বপ্ন, মায়ের মুখে সিঁদুরের লাল আভা আর পরিবারের কেনাকাটার উৎসব হয়ে ওঠে বছরের অন্যতম বড় অর্থনৈতিক পর্ব। এই সময় হিন্দুদের ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ লাগে, মণ্ডপ সাজে আলোয়-আলোয়। সেই সঙ্গে প্রতিটি বাজারে শুরু হয় অর্থনীতির উৎসব—যা শুধু ভক্তি নয়, দেশের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ ব্যবসাকে এগিয়ে নেওয়ার শক্তিশালী ক্ষেত্র।
পূজার আগে বাজারে আনন্দের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে, শহরের অলি-গলি থেকে বড় শপিংমল, গ্রামের হাট, স্থানীয় দোকান এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। প্রতিটি কোণায় শুরু হয় বেচাকেনার জোয়ার—ফুল বিক্রি থেকে কাপড়ের দোকান, অলঙ্কারের কারিগর থেকে ই-কমার্স ব্যবসা, প্রত্যেকে খুঁজে পায় পূজার এই সময়ে ব্যবসায়িক সাফল্যের পথ। ফলে দুর্গাপূজা কেবল ধর্মীয় উৎসব নয়, হয়ে ওঠে এক সমন্বিত অর্থনৈতিক শক্তির উৎস।
ঢাকার শাঁখারীবাজারে প্রতিমার মুকুট, শাঁখা, সিঁদুর কিংবা ফুলের মালা কিনতে মানুষের ভিড় দেখে বুঝতে পারা যায় এটি শুধু ধর্মীয় আচার নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যরও এক প্রাণবন্ত উৎসব। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা এই সময়ে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পান। কুমোরপাড়ার কারিগররা প্রতিমা গড়ায় ব্যস্ত, সোনা-রুপার শিল্পীরা বানাচ্ছেন নতুন অলঙ্কার, আর পোশাক ব্যবসায়ীরা খুঁজে নিচ্ছেন বাড়তি আয়ের আনন্দ। একই সঙ্গে খাবারের দোকান, পরিবহন খাত, এমনকি অস্থায়ী স্টলগুলোরও রমরমা ব্যবসা হয়। ফলে দুর্গাপূজা হয়ে ওঠে এক সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু।
সব মিলিয়ে, বাংলাদেশের দুর্গাপূজা আজ আর কেবল ভক্তির আয়োজন নয় বরং একটি জাতীয় অর্থনৈতিক উৎসবে রূপ নিয়েছে। এই উৎসবের আবেগে যেমন মানুষ মিলিত হয়, তেমনি অর্থনীতিও প্রাণ ফিরে পায়। ভক্তি আর অর্থনীতির মিলনে দুর্গাপূজা পেয়েছে নতুন রূপ।
সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর দেশে মোট ৩৩,৩৫৫টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপিত হচ্ছে। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই এবার পূজা হচ্ছে প্রায় ২,৫৮০টি মণ্ডপে। এটি যেমন শহরের বিপুল জনঘনত্বের প্রতিচ্ছবি তেমনি ঢাকার অর্থনৈতিক গুরুত্বেরও এক সুস্পষ্ট প্রমাণ। প্রতিটি মণ্ডপকে ঘিরে শুরু হয় কয়েক মাসব্যাপী প্রস্তুতি—প্রতিমা গড়া থেকে শুরু করে অলঙ্করণ, মণ্ডপের নকশা, আলোকসজ্জা, বাদ্যযন্ত্রের আয়োজন, প্রসাদ প্রস্তুতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, এমনকি ডিজিটাল প্রচারণা পর্যন্ত। এই প্রতিটি ধাপে যুক্ত থাকেন অসংখ্য মানুষ—কারিগর, শ্রমিক, উদ্যোক্তা ও স্বেচ্ছাসেবক। কারও হাতে রংতুলি, কারও হাতে বাঁশ ও কাপড়, কেউ আবার ব্যস্ত আলোকসজ্জা নিয়ে। ফলে দুর্গাপূজায় প্রতিটি মণ্ডপ পরিণত হয় একেকটি ক্ষুদ্র বাজারের প্রাণকেন্দ্রে।
ফুলচাষি তার ফুল বিক্রি করছেন, কাপড়ের দোকানি নতুন শাড়ি বা পাঞ্জাবি তুলে ধরছেন, মিষ্টির কারিগররা ব্যস্ত নতুন অর্ডার সামলাতে, আবার আলোকসজ্জার কারিগররা আলো দিয়ে সাজাচ্ছেন পুরো এলাকা। এমনকি ডিজিটাল ব্যানার, অনলাইন প্রচারণা এবং ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট খাতেও জোয়ার দেখা যায়। সবার জীবনেই খুলে যায় বাড়তি আয়ের পথ।