কথা ছিল চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার কাজ সেরে আমরা দামুড়হুদা হয়ে তারপর মেহেরপুরের মুজিবনগরে যাব। আশরাফ আলীর নানার বাড়ি সেখানে। রাজহাঁসের ব্যবস্থা হবে। আজকাল সবকিছুতেই হাঁস ঢুকে যায়! আলমডাঙ্গার হারদী বাজারে চায়ের পেয়ালা হাতে নিতে না নিতেই আশরাফ আলীর মুঠোফোন বেজে ওঠে। সেটা ৫ সেপ্টেম্বরের কথা।
আশরাফ আলী স্থানীয় একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি হঠাৎ জোরে জোরে দুবার ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়েন। ফোন রেখে বলেন, ‘আমাকে এখনই মুজিবনগর যেতে হবে; পচি বু মারা গেছে।’
পচি খাতুনের বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ওপারে নদীয়া জেলার চাপড়া থানার হৃদয়পুরে থাকতেন। সীমান্তের এখন সেদিন নেই। আশরাফ আলীরা এখন চাইলেই ভাইবোনদের দেখতে যেতে পারেন না। তালের পিঠা, হাঁসের মাংস আদান-প্রদানের সেই ছাড় এখন কেউ কাউকে দিচ্ছে না। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ করতে বসে র্যাডক্লিফ নিজের পকেটের কলম দিয়ে যে রেখা টেনেছিলেন, তাতে অনেক অঞ্চলে একই বসতবাড়ির এক অংশ ভারত, অন্য অংশ তৎকালীন পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। সেটা আর কেউ বদল করার সাহস করেনি।
তাড়াহুড়ার সেই ভাগ করার ঘটনায় পচি খাতুনের নানার বাড়ি পড়ে মেহেরপুরের মুজিবনগরের বৈদ্যনাথতলায়। গ্রামটি আবার ঘেরপাড়া নামেও পরিচিত। দাদাবাড়ি চলে যায় ভাগরেখার ওপারে নদীয়ার চাপড়ার হৃদয়পুর গ্রামে। বলতে গেলে পাশাপাশি দুই গ্রাম। ওপারে হৃদয়পুর, এপারে ঘেরপাড়া। এপারের শিরনির গন্ধ ওপারে চলে যায়। আত্মীয়স্বজন শুধু জানে ওখানে ভালোমন্দ রান্না হচ্ছে। হাঁকডাক, কান্নাকাটি সব কানে আসে কান পাতার আগেই। শিরনির গন্ধের দূরত্বে থাকা দুই গ্রামের মানুষের নিজেদের মধ্যে দেখাশোনার কোনো সোজা পথ নেই।
আগে ঘেরপাড়া গ্রামে এলেই মনে পড়ত ১৯৬০ সালে প্রভাতচন্দ্র সেন সম্পাদিত ও প্রকাশিত, চার দশকের বাংলা গান সংকলনটির ২১ পৃষ্ঠায় লেখা গানটির কথা। ‘শিয়ালদহ গোয়ালন্দ আজও আছে ভাই/ আমি যাব আমার দেশে সোজা রাস্তা নাই।’
পাসপোর্ট-ভিসা করে দর্শনা-গেদে দিয়ে পাশের গ্রামে পৌঁছাতে প্রায় এক দিন চলে যায়। এখন চাইলেও ভিসা পাওয়া যায় না সহজে। পচি খাতুন বুঝতে পেরেছিলেন, ‘আল্লার ইশারা’ হয়ে গেছে। তাই খুবই পেরেশান ছিলেন একবার বাংলাদেশের ঘেরপাড়ায় নানাজির বাড়ির দাওয়ার গন্ধ নেওয়ার জন্য। মামাতো-খালাতো ভাইবোনদের গায়ের-হাতের ছোঁয়া নেওয়া।...আশরাফ আলী গলগল করে বলে যান তাঁর বুজির কথা।
অনেকবার শোনা কথা, তবু পুরোনো মনে হয় না। মহররম মাসে পুঁথিপাঠের শ্রোতার অপার মুগ্ধতা নিয়ে শুনতে থাকি আশরাফ আলীর বুজি-বন্দনা, বুজির জন্য তাঁর মাতম। মামা-খালার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় হওয়ায় তাঁকে সবাই বুজি বলত; এমনকি পাড়ার সবাই তাঁকে সেই সম্মানই দিত। গুরুজন স্থানীয়দের কাছে পচি খাতুন ছিলেন আদরের ‘বড় বেটি’। এপারে যাঁর বাড়িতেই বিয়েশাদি লাগুক না কেন, বুজি সব সময় ‘চিফ গেস্ট’। তখন সীমান্তের কড়াকড়ি এ অঞ্চলে ছিল না। স্থানীয় লোকজনের অনেকে বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে কিছু ‘গুঁজে’ দিলেই চলত।
একাত্তরে ‘বড় বেটি’ সত্যি এক বড় বেটি হয়ে ওঠেন। প্রাণভয়ে এপার থেকে ছুটে যাওয়া প্রায় সবাই হৃদয়পুরে মিয়াবাড়িতে জিরিয়েছেন। রাত কাটিয়েছেন একটা হিল্লে হওয়ার আগে। মিয়াবাড়ির গিন্নি তখন পচি খাতুন। মিয়াবাড়ির চুলা জ্বলত সারা দিন, সারা রাত; চুলার পেছনে ঠায় বসে থাকতেন পচি খাতুন। সব শরণার্থীই যেন তাঁর নানার বাড়ির লোক। মিয়ার গিন্নিকে ভাবি বলে সম্বোধন করার বিধান ছিল না।
পচি খাতুন বলতেন, ‘আমি তোমাগের মেয়ে, ভাবিভুবি না।’ সবাই তাঁকে তাই বুবুই ডাকত। কেউ কেউ শুধু ‘বু’, আবার কেউ বুজি। নানাবাড়িতে জন্ম হয়েছিল পচি খাতুনের। বলতেন, ‘ওপারে আমার নাড়ি পুঁতা আছে।’ মরার আগে একবার তিনি নানার ভিটায় আসতে চেয়েছিলেন। এখনকার পরিস্থিতি সেটা হতে দেয়নি।