কিছুদিন আগে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হলো। নানা দলের নানা অভিযোগ, কারোবা আত্মপক্ষ সমর্থন। ভাবখানা অনেকেরই, বিশেষ করে মূলছিন্ন বাম সেক্যুলারিস্টদের, এরকম : “অন্য কেউ না জিতলে পদ খালি পড়ে থাক, কিন্তু ‘উগ্রবাদী-মৌলবাদী শিবির’ কেন?” তাও আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জায়গায়! আমরা জাতিগতভাবে কিংবা আত্মজিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে সম্ভবত দেউলিয়াগ্রস্ত হয়ে গেছি; বিশেষভাবে বাঙালি মুসলমানরা। অনেক বছর থেকে লক্ষ করে আসছি-দালালি, মুনাফেকি, আত্মপ্রবঞ্চনা কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা ও স্বার্থপরতায় আমরা সেরা বলে দাবি করতে পারি। পতিত আওয়ামী লীগ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। নিজেরা কথা রক্ষা করেনি, কপটতা করে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করা হয়। আমরা জাতীয় স্বার্থে একমত হতে পারি না, টালবাহানা করি। দিন যত সামনে এগোচ্ছে, এসব বিষয়ে আমাদের উন্নতির যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।
আসলে কোনো দেশে দীর্ঘদিনের অপশাসন, নির্জলা মিথ্যাচার, নিখাদ কর্তাভজন-তৈলমর্দন সামাজিক বিবেকবোধ ও আত্মজিজ্ঞাসাকে অধঃপতনের প্রান্তসীমায় নিয়ে যায়। এদেশে এসবের জয়জয়কার, সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে। এসব চাঁছাছোলা কথা বেশির ভাগ পাঠক অপছন্দ করেন, ‘ভদ্দরলোকেরা’ তো বটেই। আওয়ামী লীগ লক্ষ-কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে; এতে যতটা না উদ্বিগ্ন, তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত সমাজের প্রভাবশালী ও সুযোগসন্ধানী লোকজন এবং রাজনৈতিক দলীয় নেতা-কর্মীদের চরিত্রকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে, যার মেরামত কষ্টসাধ্য কিংবা সুদূরপরাহত। দেশের জন্য এটা সবচেয়ে বড় ক্ষতি। এ ক্ষতি আমাদের মনে দাগ কাটে না।
সবকিছুরই ভেদ জানা প্রয়োজন। ব্রাহ্মণ্য বর্ণবৈষম্যবাদ ও ধর্মীয় বহুত্ববাদের বিপরীতে একত্ববাদ, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববাদ প্রচারের আদর্শ নিয়ে এ উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার হয়; কোনো তলোয়ার প্রয়োগের মাধ্যমে নয়। ভারতবর্ষে মোগল ও অন্যরা এসেছিল দেশ লুটপাট করে পালিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, বসবাসের জন্য। তাদের আগমনে ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা সমৃদ্ধ হয়েছিল। পার্শ্ববর্তী একই অঞ্চল থেকে এর আগে এসেছিল জাত্যাভিমান ব্রাহ্মণরা, যারা নিজেদের আর্য বলে দাবি করত। তারা একই পূজার বেদিতে ফুল দিতে এসে বৈষম্যবাদী হিন্দু সমাজে মিশে গেছে। বহিরাগত নাম মুছে গেছে। ভারতবর্ষে ৬শ বছর মুসলিম শাসন হিন্দু ও মুসলিমদের একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় রাষ্ট্রে একীভূত করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন আসার পর তাদের সঙ্গে নিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তা-চেতনা মুসলমানদের কোণঠাসা করে ফেলে এবং ভারতবর্ষ থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করার ফন্দি তৈরি করে। সে থেকেই মুসলমানদের প্রতি অত্যাচার ও নিগ্রহ শুরু হয়। ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করতে মুসলমানরাই প্রথমে এগিয়ে এসেছিল। ভারতবর্ষের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদ, কুসংস্কার, মুসলিমবিদ্বেষী কর্মকাণ্ড অনেক পুরোনো; বরং মুসলমান-অধ্যুষিত অনেক অঞ্চল হিন্দুত্ববাদী দিল্লি-শাসন দখল করে নিয়েছে। বাংলাদেশ অঞ্চলের মুসলমানদেরও হিন্দুত্ববাদী দিল্লি শাসকগোষ্ঠী মেনে নিতে পারেনি। তারা এ অঞ্চলটাও দখল করতে চায়। এরা মুসলমান কালচারকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করে মুসলমানদের বহুত্ববাদী ও ভোগবাদী সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত করাতে চায়। এরা চায় নামাজ-রোজা, একত্ববাদের বিশ্বাস দেখলেই নামের ও কর্মের সঙ্গে ‘জঙ্গি ও মৌলবাদী’ ট্যাগ ঝুলিয়ে দিয়ে মুসলমানি সভ্যতাকে দমন করে রাখতে এবং ক্রমশ এ জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে। বাম-সেক্যুলারিস্টরা এসব কাজে এদের সহযোগী। পশ্চিমের ভোগবাদ-ক্লান্ত সভ্যতা, ইসরাইল রাষ্ট্র নামের বিষবৃক্ষের রোপণ ও পরিচর্যাও বিশ্বব্যাপী মুসলমান সভ্যতা দমন বা নিশ্চিহ্ন করার এ চেষ্টা অব্যাহত রাখবে বলে ধারণা করা যায়।
ভারতীয় আধিপত্যবাদী এদেশীয় দালালেরা নিজেদের স্বাধীনতা ও অস্তিত্বের কথা ভুলে গিয়ে ভারতীয় স্বার্থের কাছে মাথা নত করে; শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগ দেয়। মুসলিম ও বিরোধীপক্ষ নিধন পুরোদমে চলতে থাকে। দেশ প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়াগ্রস্ত হওয়ার উপক্রম হয়। বর্তমানে হাসিনা ভারতে বসে প্রভুকে সঙ্গে নিয়ে আবার ক্ষমতাসীন হওয়ার কুটিল বুদ্ধি আঁটছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ইসলামবিদ্বেষী বাম-সেক্যুলারদের মধ্যে ভারতীয় ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তি ইসলামবিদ্বেষী বীজ রোপণ করতে সক্ষম হয়েছে। এদেশের অনেক সচেতন মুসলমানদের পক্ষে ভারতের ‘দাদাগিরি’, হিন্দু আধিপত্যবাদ, অর্থনৈতিক শোষণ, তাঁবেদারি ও আশ্রিত রাষ্ট্রের মর্যাদা কোনোদিন মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি; হয়তো মেনে নেওয়া আর কোনোদিন সম্ভব হবেও না, যদিও বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে বইয়ে দেওয়ার জন্য ‘মুসলিম মৌলবাদী’ শক্তির উত্থানের কল্পিত জুজুর ভয় দেখানো কিছু রাজনৈতিক দলের নিত্যকর্ম।
বনের একটা অবলা পাখিও স্বাধীনতার আস্বাদন পেতে চায়। এদেশের প্রত্যেক নাগরিক ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশপ্রেমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দেশকে ভালোবাসবে, দেশের স্বার্থে জীবন দেবে, এটাই স্বাভাবিক চাওয়া, মানুষের স্বভাবজাত প্রত্যাশা। অন্য কোনো দেশের প্রত্যাশা পূরণ ও নিজেদের অস্তিত্বকে তাদের পদমূলে বিলিয়ে দেওয়া মেনে নেওয়া যায় না, এটা দেশের সঙ্গে গাদ্দারি। স্বাধীনতার পেটেন্ট-স্বত্বধারীর দাবিদার আওয়ামী লীগ ও তাদের এদেশীয় দোসররা স্বাধীনতা রক্ষার মোড়কে, মৌলবাদ দমনের ধুয়া তুলে দেশের সার্বভৌমত্বকে অর্ধেক বিক্রি করে ছেড়েছে ভারতের কাছে। শেখ হাসিনার জীবদ্দশাতেই বাকি অর্ধেক বিক্রি করার তোড়জোড় চলছিল।