সৌদি আরব ও পাকিস্তান এক সামরিক চুক্তিতে সই করেছে গত বুধবার ১৭ সেপ্টেম্বর। আর তাতেই দুনিয়াজুড়ে বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক স্বার্থের দেশগুলোতে ও আমাদের এ অঞ্চলে ব্যাপক হইচই পড়ে গেছে। অনেক পশ্চিমা মিডিয়া একে পৃথিবীর ভূমিগঠন কাঠামোতে কয়েকটা ইট খুলে নেওয়ার মতো ‘টেকটনিক’ পদক্ষেপ বলেছে।
কী সেই চুক্তি
আনুষ্ঠানিকভাবে এর নাম ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি’ যা ইংরাজিতে ‘স্ট্রাটেজিক মিউচুয়াল ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট’। এখানে ‘মিউচুয়াল ডিফেন্স’ শব্দগুলো সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। এককথায় এর অর্থ হচ্ছে, কোনো শত্রুর দ্বারা চুক্তির এক রাষ্ট্র আক্রান্ত হলে সেটা অপর রাষ্ট্র নিজের ওপর আক্রমণ মনে করবে, আর নিজ বন্ধুকে রক্ষায় মোকাবিলায় এগিয়ে সক্রিয় পদক্ষেপ নেবে; দুই. বন্ধুর শত্রুর বিরুদ্ধে যৌথভাবে লড়বে।
‘মিউচুয়াল ডিফেন্স’ শব্দটার অর্থ খুবই গভীর। আর তা হওয়ার পেছনে বা এই আইডিয়ার উপরই দাঁড়িয়ে জন্ম নিয়েছিল ও আছে ১৯৪৯ সাল থেকে ন্যাটো (নর্থ আটল্যান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশন)। ন্যাটোর জন্ম দলিলের বিখ্যাত হলো ‘অনুচ্ছেদ পাঁচ’। এটা লেখা হয়েছে উপরে ‘মিউচুয়াল ডিফেন্স’ ধারণার আলোকে। দুনিয়াতে সেটিই প্রথম মিউচুয়াল ডিফেন্স ধারণার ব্যবহার। বইয়ের ভাষায় একে ‘কালেকটিভ ডিফেন্স প্রিন্সিপালও’ বলা হয়ে থাকে। মোট ৩২ সদস্যের ন্যাটোর কোনো এক সদস্য কোনো বাইরের দেশ দ্বারা আক্রান্ত হলে এর বিরুদ্ধে ন্যাটো-সদস্যরা একসঙ্গে প্রতিরোধে নেমে পড়তে বাধ্য।
এ কারণে অনেকেই সৌদি আরব-পাকিস্তান চুক্তিকে মুসলিম ন্যাটো চুক্তি বলে উচ্ছ্বসিত হচ্ছে; আর ততই এটা ভারতের জন্য হতাশার। কারণ সৌদির সঙ্গে অপর দেশটা হলো পাকিস্তান, যে পারমাণবিক শক্তিধর! আর পাকিস্তানের অপর পার্টনার সৌদি আরব বলে এর অর্থ হলো, সামরিক প্রস্তুতিতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে অর্থ আর বড় কোনো বাধা নয়। আর সেই সঙ্গে এখন ক্রমশ এই চুক্তিতে শামিল হতে চাইবে পুরো মধ্যপ্রাচ্য বাদশাহশাসিত দেশের ‘জিসিসি জোটে’র ছয় দেশ (সৌদি ছাড়াও বাকি পাঁচ দেশ-ইউএই আমিরাত, কাতার, কুয়েত, বাহারাইন ও ওমান)।
অনেকে অবশ্য আরেক সম্ভাবনার দিকটা দেখে বলতে শুরু করেছেন যে, এটা হয়তো ইরানকে একঘরে করার সৌদির পরিকল্পনা। না, এটা একেবারেই ভুল ব্যাখ্যা হবে। এটা কার্যত মুসলিম দুনিয়ার রাষ্ট্রগুলোর আন্তঃসম্পর্কের মধ্যে দুর্বলতাগুলোকে বড় করে দেখিয়ে ‘মুসলিম ন্যাটো’ হয়ে ওঠার সম্ভাবনাকে জেনে না জেনে, ফেরকার কথা তুলে নাকচ বা খামোস করার এক বৃথা চেষ্টা হবে।
তাহলে দুর্বলের বদলে সবল দিকটা কী
সারা দুনিয়ায় বা এর নানা ভৌগোলিক অঞ্চলে নানা রাষ্ট্রস্বার্থ দ্বন্দ্ব থাকে, থাকবেই। কিন্তু তবু সবকিছুর ঊর্ধ্বে আবার একটাই ‘প্রধান দ্বন্দ্ব’ থাকবে! যেমন, এখনকার দুনিয়ায় সেই প্রধান দ্বন্দ্বটা হলো-‘চীন-আমেরিকার বিরোধ’! এটি মূলত অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব-এক পালাবদল মানে একালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নেতৃত্বের পালাবদলের কাল এটা। যদিও ক্রমশই এটা সামরিক, কৌশলগত, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি এবং সর্বোপরি এক নয়া বয়ান হয়ে সব ফ্রন্টেরও দ্বন্দ্ব হয়ে ক্রমশই ছড়িয়ে পড়বে।
আর আমরা বাকি সব রাষ্ট্রই ক্রমশ এই চীন-আমেরিকা দ্বন্দ্বে নিজ নিজ রাষ্ট্রস্বার্থের আগ্রহে বা বিচারে এ দুই রাষ্ট্রের কোনো একটার স্পষ্ট পক্ষভুক্ত হতে থাকব। অনেকে ইতোমধ্যেই হয়ে গেছি বা আছি। যদিও দ্বন্দ্ব-বিকাশিত হওয়ার বর্তমান স্তরে বা পর্যায়ে পরিষ্কার করে আমাদের-হয় আমেরিকা না হয় চীনের পক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়া- দেখা নাও যেতে পারে। এখন হয়তো দেখা যাবে, একটা রাষ্ট্র এখনই ৫০-৮০ শতাংশ চীনের পক্ষভুক্ত হয়ে গিয়েও পাশাপাশি আমেরিকার সঙ্গেও অবশিষ্ট মাত্রার ঘনিষ্ঠতা রাখছে। যেমন পাকিস্তান। এখানে চীনা বিনিয়োগ ইতোমধ্যেই ২০ বিলিয়ন আর তা আগাচ্ছে ৫০ বিলিয়নের আশপাশে যাওয়ার লক্ষ্যে, যদিও এই বিনিয়োগের বেনিফিট ব্যবহারকারী আবার খোদ চীন নিজেও-সেটা গোয়াদর প্রকল্পকে কেন্দ্র করে। আসলে এটি সাড়ে তিনদিক ল্যান্ডলকড চীন যার আবার পশ্চিমদিক একেবারে সুউচ্চ পর্বতমালা দিয়ে ব্লকড। তবু এই পশ্চিম দিকটা দিয়েই পাকিস্তানের সারা বুক চিরে এখন সমুদ্রে ডিপ সি-পোর্টে পৌঁছানোরই অবকাঠামো নির্মাণ করে নেওয়া হয়েছে; যার বৃহৎ ব্যবহারকারী হবে চীন নিজেই। তাই বলা যায়, চীন-পাকিস্তানের সম্পর্ক অর্থনৈতিক অবকাঠামো বিনিয়োগের হলেও সবার উপরে এটা খোদ চীনের স্ট্রাটেজিক স্বার্থ-এক কথায়, চীন নিজ পুবদিকের চীন সাগর ছাড়াও চীন এখন নিজ পশ্চিমদিক দিয়ে সরাসরি আরব সাগরে পৌঁছাতে পারে।
অথচ এতকিছুর পরও পাকিস্তান আমেরিকার হাতও ছাড়েনি; একটু দুর্বলভাবে হলেও সঙ্গেই ধরে আছে। আবার পাকিস্তানের মূল অর্থনৈতিক সম্পর্কের পুরোটাই চীননির্ভর। আবার এই সৌদি-পাকিস্তান সামরিক চুক্তির পর থেকে পাকিস্তান হয়ে গেল ইসলাম জনসংখ্যাপ্রধান রাষ্ট্রগুলোর চোখে রক্ষাকর্তা-অন্য ভাষায় হবু ইসলামি ‘ন্যাটোর’ মধ্যমণি।
কেন আমেরিকান প্রেসিডেন্টরা নেতানেয়াহুর খেদমতগারির প্রতিযোগিতায়
ইসরাইল ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফিলিস্তিনিদের জায়গাজমি দখল, তাদের উদ্বাস্তু বানানো থেকে শুরু করে এমনকি হত্যা, নির্যাতন করে চলেছে। এর সবই দখলবাজদের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের কাজ’ বলে সাফাই দিয়ে পশ্চিমাজগৎ জায়োনিজমকে উসকানি গেছে। এসবই জায়োনিস্ট ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তারের নৃশংস ইতিহাস। বিশ্বযুদ্ধ শেষে বৈশ্বিক নেতা হিসাবে আমেরিকান উত্থান আর ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা একসঙ্গে হাত ধরাধরি করেই চলেছে। এক কথায় ইসরাইলকে প্রটেকশন দিয়ে অন্যের দেশভূমি দখল করে নিজ বিস্তার ঘটানো-প্রটেকটর যেহেতু আমেরিকা, তাই পরিষ্কার করেই বলা যায় যে, দুনিয়া থেকে জায়োনিজমের অবসান ও ইসরাইল রাষ্ট্রের বিলুপ্তি বৈশ্বিক নেতা হিসাবে আমেরিকার পতনের ভেতরই নিহিত। প্রটেকটর আমেরিকার নেতাগিরির পতনের ভেতর দিয়েই ইসরাইলের বিনাশ ঘটবে, তা বলাই বাহুল্য।