হেরে যাওয়ার আগে শেষ যুদ্ধে মোদি

যুগান্তর ভারত অনিকেত চট্টোপাধ্যায় প্রকাশিত: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:৪৫

নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার শেষ খেলাটাই খেলে যাচ্ছেন। ভোট লুটের একের পর এক তথ্য বলে দিচ্ছে, মানুষের রায়ে নির্বাচিত হয়ে এই সরকার আসেনি। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে মোদি সরকারের। এবার মানুষ রাস্তায় নামবে। এখন ধর্মের তাস ছাড়া বিজেপির হাতে আর কিচ্ছু খেলার নেই। তাই সেই পচে-ধসে যাওয়া পুরোনো ইস্যুকে বারবার পকেট থেকে বের করছেন মোদি। সেই ধর্মের তাস খেলে বৈতরণী পার করার চেষ্টায় আছেন তিনি। বিহারের জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য রেখেছেন, তা সেই আলোচনার এক প্রতিধ্বনী। সেখানে তিনি বলেছেন, দেশের জনসংখ্যার চরিত্র দ্রুত বদলে যাচ্ছে। জনবিন্যাস, ডেমোগ্রাফিক ম্যাপ নাকি দ্রুত বদলে যাচ্ছে, বিশেষ করে বিহারের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে এবং এর জন্য তিনি অনুপ্রবেশকারীদের দায়ী করেছেন। অনুপ্রবেশকারী কারা, কোথা দিয়ে ঢুকবে? আমাদের দুটো বর্ডার থেকে অনুপ্রবেশ হয়, একটা পাকিস্তান বর্ডার, সেখান থেকে তো ঢুকে বাংলা পর্যন্ত আসবে না, আসাম পর্যন্ত আসবে না। তার মানে বাংলাদেশ থেকে ঢুকে তারা আসাম, বিহার, বাংলা, ত্রিপুরা-এসব জায়গায় চলে যাচ্ছে! এই যে অনুপ্রবেশ, তার জন্য তিনি কাকে দায়ী করছেন? বিরোধী দলগুলোকে, এই অনুপ্রবেশকারীদের সমর্থন করার জন্য এবং ভোটের রাজনীতি করার জন্য তাদেরকে ব্যবহারের অভিযোগ করছেন। যা আসলে তিনি বলতে চাইছেন তা হলো, বাংলাদেশ থেকে মুসলমানদের নিয়ে এসে বিরোধীরা সংখ্যালঘুদের সমর্থন নিয়ে দেশ চালানোর চেষ্টা করছেন। কেবল বলছেন না, সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিএসএফ গার্ড এবং অফিসাররা কোন্ দুব্যঘাস ছিড়ছিলেন, যখন এই মুসলমানরা দলে দলে ভারতে ঢুকছিল!


তিনি আরেক ধাপ এগিয়ে একে এক বিরাট ষড়যন্ত্র বলে দিলেন। জানালেন, এর প্রতিকারেই নাকি চালু হতে চলেছে ডেমোগ্রাফিক মিশন! প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, তা নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন করাই যায়। প্রথমত, অনুপ্রবেশের প্রশ্নটা তো ছেলেখেলার নয়। ফলে দেশের সর্বোচ্চ আসন থেকে কিছু বলতে গেলে সেই বক্তব্যের পক্ষে যথেষ্ট প্রামাণ্য-পরিসংখ্যান থাকতে হবে। তিনি কি কোনো পরিসংখ্যান দিয়েছেন? অনুপ্রবেশের চেষ্টা করতে গিয়ে কতজন ধরা পড়েছে, তার কোনো হিসাব দিয়েছেন? ধরুন ১০০ জন ঢুকতে গিয়ে হয়তো ১০ ধরা পড়েছে। তাই যদি হয়, তাহলেও তো হিসাব মেলে না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হিসাব বলছে, ২০১৬ সালে ভারতে অনুপ্রবেশের সময় মোট ১,৬০১ জন বাংলাদেশি ধরা পড়েছে। ২০১৭ ও ২০১৮ সালে সংখ্যাটা ৯০৭ ও ৮৮৪; ২০১৯-এ ১১০৯ এবং ২০২০ সালে মাত্র ৯৫৫ জন ধরা পড়েছে। বিএসএফের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ৪,৮৯৬ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করার সময় আটক করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে ৪০৬ আর ২০২৪-এ ২,৪২৫ জন এবং ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ৫৫৭ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশে। সেখানেও কিছু ক্ষেত্রে বিতর্ক আছে। মানে তারা বলছেন যে, তারা ভারতের নাগরিক। এদের ব্যাপারে ভারতের কোর্টে মামলা চলছে।


এই সংখ্যাগুলো একটা দেশের, তাও আবার ভারতের মতো জনবহুল দেশের জনবিন্যাস পালটে দেওয়ার পক্ষে নিতান্তই অকিঞ্চিৎ। কেউ এরপর জনবিন্যাস বদলে যাওয়ার দাবি করলে তাকে পাগল বা শয়তান বলা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় থাকে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে যদি অনুপ্রবেশকারীদের অন্য কোনো সংখ্যা থাকে, তা প্রকাশ করা হোক। না হলে প্রধানমন্ত্রীর কথাগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন, ছেদো, রাজনীতির ভাষা হিসাবে থেকে যাবে যে, একজন প্রধানমন্ত্রী মঞ্চে দাঁড়িয়ে মিথ্যা বলছেন।


অবশ্য তিনি সবসময় মিথ্যা বলেন এবং মাথায় রাখুন, ২০১১ সালের পর ভারতে জনগণনাই হয়নি। ফলে অঞ্চলভিত্তিক জনবিন্যাসে পরিবর্তন ঘটছে কিনা, সরাসরি তা জানারও কোনো নিশ্চিত উপায় নেই। ২০১১ সালের জনশুমারী পরিসংখ্যানের প্রেক্ষিতেও যদি কিছু অনুমান করা হয়, আর ২০১৯-এ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে এ কথা বলার কোনো উপায় নেই বা কোনো তথ্যযুক্তি নেই যে, সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে জনবিন্যাস অনুপ্রবেশের কারণে পালটে যাচ্ছে।


ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে রিপোর্ট কী বলছে? পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ১৯৮১ সালে ৫ কোটি ৪৫ লাখ ৮০ হাজার ৬৪৭। ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৬ কোটি ৮০ লাখ ৭৭ হাজার ৯৬৫, ২০০১ সালে সেটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৮ কোটি ১ লাখ ৭৬ হাজার ১৯৭; ২০১১ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ১২ লাখ ৭ হাজার ৬১৫-তে। তো বৃদ্ধির হার কীরকম? ১৯৮১ সাল থেকে ’৯১ পর্যন্ত ২৪.৭০ শতাংশ, ’৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ১৭.৮০ শতাংশ; ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ১৩.৮০ শতাংশ। তাহলে হার বাড়ার কোনো লক্ষণ আছে কি? না নেই। বরং কমছে। এটা সেন্সাস রিপোর্ট। গত তিন দশক ধরে কমছে। আচ্ছা, বাঙালি হিন্দুদের জনসংখ্যা কীরকম অবস্থায় আছে? ১৯৮১ সালের রিপোর্ট বলছে, ৪ কোটি ১ লাখ ৫ হাজার ২৬৬; ১৯৯১ সালে ৫ কোটি ৮ লাখ ৬ হাজার ৬২৪; ২০০১ সালের রিপোর্ট বলছে ৫ কোটি ৮১ লাখ ৪ হাজার ৮৩৫ আর ২০১১ সালের রিপোর্ট বলছে ৬ কোটি ৪৩ লাখ ৮ হাজার ৫৪৬। তার মানে বাঙালি হিন্দুর বৃদ্ধির হার হচ্ছে, ’৮১-৯১-এ বেড়েছে ২১ শতাংশ; ’৯১ থেকে ২০০১ সালে বেড়েছে ১৪.২ শতাংশ; ২০০১-২০১১ সালে বেড়েছে ১০.৮ শতাংশ। মানে কমছে। গত তিন দশক ধরে কমছে অর্থাৎ ২০ বছরে ২১ থেকে ১০-এ নেমেছে। আচ্ছা, বাঙালি মুসলমানদের জনসংখ্যা নিয়ে তো সবার ইন্টারেস্ট আছে, দেখা যাক সেটার কী অবস্থা। ১৯৮১-তে ১ কোটি ১৭ লাখ ৪০ হাজার ২৯৭; ১৯৯১ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ৭ হাজার ৫৩৬; ২০০১-এ ২ কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার ৫৪৩ আর ২০১১ সালে ২ কোটি ৪৬ লাখ ৫ হাজার ৪২৫। তাহলে বৃদ্ধির হারটা কীরকম? ’৮১-৯১ সালে ৩৬ শতাংশ; ’৯১-২০০১ সালে ২৫.৯ শতাংশ; ২০০১-১১ সালে ২১.৮ শতাংশ। মানে ৩৬ থেকে ২১-এ নেমে গেছে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার। তার মানে কমছে। দুই. গত ৪০ বছরে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে বেশি কমেছে। তিন. বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমান, দু’পক্ষেরই জাতীয় গড়ের থেকে বাংলায় বৃদ্ধির হার কম। চার. কোটি কোটি লোক বর্ডার পার হয়ে এলে ফলাফল অন্যরকম হতো। পাঁচ, যাদের ঝগড়া লাগানো কাজ, তারা বলতেই পারেন, বর্ডারের পাশের জেলাগুলোর জনসংখ্যা ভালো করে দেখতে হবে। আচ্ছা তা-ই হোক, পরিসংখ্যান তো আছেই। কোনো কোনো জেলায় বৃদ্ধির হার পশ্চিমবঙ্গের গড়হার থেকে বেশি। যেমন-উত্তর দিনাজপুর, মালদা। আবার কোনো কোনো জেলায় এটি গড়হারের চেয়ে কম, যেমন-নদীয়া, দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, যে জেলায় হিন্দুদের বৃদ্ধির হার সবচেয়ে বেশি, সেখানে মুসলমানদের বৃদ্ধির হারও বেশি। মানে হিন্দুরও বেশি, মুসলমানদেরও বেশি। আবার যেখানে হিন্দুরা কম, সেখানে মুসলমানরাও কম।


প্রশ্ন হলো, অনুপ্রবেশের প্রমাণ কই। কোনো প্রমাণ নেই। আসলে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাম, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে আগুন নিয়ে খেলছেন। এই রাজনৈতিক খেলা শেষ পর্যন্ত দেশের ভবিষ্যতের জন্য এক নতুন বিপদ তৈরি করছে।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

এই সম্পর্কিত

আরও