বাংলাদেশে প্রায় ৬ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ আছে, যার মধ্যে কমপক্ষে ৩০০ প্রজাতির বিদেশি উদ্ভিদ রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেসব গাছপালা রয়েছে, তার ৪১ শতাংশই বিদেশি উদ্ভিদ। ঢাকার সড়ক বিভাজকে লাগানো ৫৬ শতাংশ গাছ বিদেশি। ইপিলইপিল, মেহগনি, বাওবাব, ব্রেডফ্রুট, হিমঝুরি, কাঞ্চন, গাঁদা, ল্যান্টানা, ইউক্যালিপটাস, আকাশমণি, মানিপ্লান্ট, পাইন, নয়নতারা, শঙ্খপুষ্প, লতাজবা, জবা, গম, ভুট্টা, আখ, সয়াবিন, চা, কফি, আনারস, তামাক, সফেদা, বাতাবি লেবু, শিশু, সরিষা, চিনাবাদাম, মসুর, মটর, ছোলা, পাতাবাহার, আসামলতা—এর কোনটি বিদেশি উদ্ভিদ না? খুঁজলে এ রকম শত শত বিদেশি গাছ এ দেশে পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশে সুপ্রাচীনকাল থেকে বহু বিদেশি উদ্ভিদের আগমন ঘটেছে। আমরা আজ যে টমেটো, বেগুন, মরিচ, পেঁপে খাই, সেগুলোও আমাদের দেশি উদ্ভিদ না। বিদেশ থেকে বিভিন্ন পরিব্রাজক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, উদ্ভিদ সংগ্রাহক, উদ্ভিদ গবেষক প্রমুখের হাত ধরে এসব বিদেশি উদ্ভিদ এ দেশে এসেছে। সেগুলোকে এ দেশের মাটিতে লাগানো হয়েছে। সেসব উদ্ভিদ ধীরে ধীরে আমাদের দেশের মাটি ও আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে এবং পরবর্তীকালে বংশরক্ষা করে চলেছে। প্রাচীনকালে অনেক নাবিক পালতোলা জাহাজে মাল বোঝাই করার পর সেসব জাহাজের ভারসাম্য রক্ষার জন্য বিদেশের যেসব বন্দর থেকে জাহাজ ছাড়তেন, সেসব বন্দরের আশপাশে থাকা গাছপালা, ঝোপঝাড় ইত্যাদি কেটে জাহাজের পাশে বেঁধে ভারসাম্য রক্ষা করতেন। এসব লতাগুল্ম, বৃক্ষ গন্তব্য বন্দরে পৌঁছানোর পর সেখানে ফেলে দিতেন। এভাবেও একসময় অনেক বিদেশি অর্কিডের এ দেশে আগমন ঘটেছে। আবার প্রাকৃতিকভাবেও অনেক উদ্ভিদ এ দেশে এসেছে। পাখি, প্রাণী, বাতাস, জলস্রোত এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে।
সম্প্রতি গাছপালা নিয়ে মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং দেশে নার্সারির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিদেশ থেকে প্রতিবছর বহু প্রজাতির নতুন উদ্ভিদ এ দেশে নিয়ে আসছেন। কেউ আনছেন শখের বশে, কেউ করছেন বাণিজ্য। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এখন বিদেশি উদ্ভিদ, বিশেষ করে সব নিয়ম মেনে লাখ লাখ টাকার উদ্যানতাত্ত্বিক উদ্ভিদ প্রতিবছর বৃক্ষমেলার আগে বিদেশ থেকে আমদানি করছে। ফলে এ দেশে বিদেশি নতুন উদ্ভিদের আগমন ও সম্প্রসারণ ঘটছে, সমৃদ্ধ হচ্ছে এ দেশের উদ্ভিদ তালিকা। বিষয়টা আনন্দের বটে।
অন্য দিকে অনেক বিদেশি উদ্ভিদ আমাদের দেশীয় প্রজাতির উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এতে দেশীয় উদ্ভিদ প্রজাতিগুলোর ওপর নির্ভরশীল অনেক জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে। সম্প্রতি ঢাকা শহরের বৃক্ষাদির অবস্থা সম্পর্কে ২০২৪ সালে প্রকাশিত গবেষণালব্ধ একটি প্রতিবেদন ‘আরবান ট্রি ইনভেন্টরি অব ঢাকা সিটি’তে দেখা গেছে যে এ শহরের প্রায় ৬৩ শতাংশ বিদেশি উদ্ভিদ, শীর্ষে রয়েছে দুই প্রজাতির বিদেশি বৃক্ষ মেহগনি, যার পরিমাণ ঢাকা শহরের মোট ১৩ লাখ বৃক্ষের প্রায় ১১ শতাংশ। অথচ আমরা জানি যে মেহগনি বৃক্ষ পরিবেশবান্ধব নয়। ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণির মতোই এর রয়েছে কিছু ক্ষতিকর প্রভাব। মেহগনির বীজ খুবই বিষাক্ত। এর ফল এতটাই বিষাক্ত যে তা ফাটিয়ে বীজ বের করে সেসব বীজ পানিতে ভিজিয়ে রেখে ছেঁকে সেই পানি ফসলের খেতে ছিটালে ফসলের সব পোকা মরে যায়, এমনকি বন্ধু জীবেরাও বাঁচতে পারে না। এমনকি এর পাতার রসও বিষাক্ত। মেহগনির পাতা যে মাটি বা জলাশয়ে পড়ে, সেখানে তার বিষাক্ত প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। এর পাতা কোনো গবাদিপশু ও প্রাণী মুখে তোলে না। তাদের দৈবজ্ঞানে তারা তা বুঝতে পারে। অথচ আমরা মানুষেরা তা বুঝি না। এর পাতা মাটি ও পানিকে দূষিত করছে, মাছসহ জলজ জীবের ক্ষতি করছে, এমনকি মেহগনিগাছে কোনো পাখিও বাসা বাঁধে না। এ গাছ যেখানে থাকে তার আশপাশে কীটপতঙ্গের আনাগোনাও কমে যায়। যদিও কিছু মৌমাছি ফুলের মধু নেওয়ার সময় আসে, তবে মৌমাছিরা কখনো মেহগনিগাছে চাক বাঁধে না। ফসলের খেতের পাশে এ গাছ থাকলে তার পাতা পড়ে সেসব খেতের বীজ গজানো ও ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এরূপ পরিবেশবিরোধী একটি গাছ এ দেশে এসেছে আমেরিকা থেকে এবং দিনদিন তা বেড়ে চলেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এখন এটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থকরী কাঠের গাছ বা টিম্বার প্ল্যান্ট। অর্থ আর কাঠের লোভে পড়ে আমরা এই বিদেশিনীকে তালাক দিতে পারছি না।
এ রকম আরেক বিদেশিনী উদ্ভিদ হলো কচুরিপানা। তার এ দেশে আগমনের ইতিহাসটা বেশ মজার। ধারণা করা হয় কচুরিপানার ফুলের সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে জনৈক ব্রাজিলীয় নাগরিক আঠারো শতকের শেষ দিকে বাংলায় কচুরিপানা নিয়ে আসেন। এর আগে অবিভক্ত বাংলার কোথাও এ আপদটি ছিল না। এরপর তা বাংলার জলাভূমিতে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে। এদের বংশবৃদ্ধি এত দ্রুত ঘটতে থাকে যে ১৯২০ সালের মধ্যে বাংলার প্রায় সব জলাশয়ে কচুরিপানা ঢুকে পড়ে। কোনো কোনো নদ-নদী নৌ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ে, পাট জাগ দেওয়ার মতো কোনো জলাশয় খুঁজে পাওয়া যায় না। এরূপ পরিস্থিতিতে তৎকালীন সরকার জলাভূমি আইনসহ বেশ কিছু আইনের সংস্কার করে কচুরিপানা ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়। সরকার ১৯২১ সালে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে সভাপতি করে একটি কমিটি গঠন করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক ড. পল ব্রুকের বিস্তারিত গবেষণা ও পরামর্শের ভিত্তিতে জগদীশ চন্দ্র বসুর কমিটি যেসব সুপারিশ করেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল কারও বাড়ির আশপাশে কোনো কচুরিপানা রাখা যাবে না, জলাশয় থেকে কচুরিপানা তুলে ধ্বংস করা নাগরিক কর্তব্য। ১৯৩৬ সালে কচুরিপানা আইন জারি, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানার অভিশাপমুক্ত করার অঙ্গীকার ইত্যাদি প্রমাণ করে যে একটি মাত্র বিদেশি প্রজাতির উদ্ভিদ পরিবেশ ও মানুষের জন্য কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক নির্বাচনে জয়লাভের পর ১৯৩৯ সালে তাঁর প্রচেষ্টায় কচুরিপানা ধ্বংস সপ্তাহ পালন করা হয়। এই একটি উদাহরণ ও ইতিহাস থেকেই বোঝা যায় যে বিদেশি উদ্ভিদ আমাদের দেশের উদ্ভিদ বৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে।