আশার বিপরীতে হতাশাই সর্বত্রে বিরাজমান

www.ajkerpatrika.com সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রকাশিত: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩:২৫

বিগত সরকারের শাসনামলে একটা প্রশ্ন বেশ আলোচিত হতো। এর পরে কী? একটা বক্তব্য চালু ছিল যে নৈরাজ্য দেখা দেবে। তেমনটা ঘটবার আগেই অবশ্য গণ-আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন ঘটেছে; কিন্তু পতনের পরে অবস্থাটা এখন যে খুব শান্ত ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে, তা তো নয়। না হওয়ার প্রধান কারণ এটা যে অভ্যুত্থানের পেছনে কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক দল ছিল না, কেউ নেতৃত্ব দেয়নি। স্বতঃস্ফূর্ততাই ছিল এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। হাল ধরার তো দরকার ছিল; কিন্তু সেটা কারা ধরবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। এর ফলে অনেক মন্দ উপসর্গ দেখা দিয়েছে। একটা হলো মামলা দেওয়ার এবং পরে অভিযুক্তদের তালিকা থেকে নাম কেটে দেওয়ার বাণিজ্য। প্রতিহিংসার অনুপ্রেরণায় মামলার আসামি করার ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে, কিন্তু এর মধ্যে বাণিজ্যও ঢুকে পড়েছে। টাকাপয়সার আদান-প্রদানের যেসব খবর শোনা গেছে, তার সবটাই যে ভুয়া তা নয়; সত্যও আছে। দ্বিতীয় উপসর্গটি হলো মব ভায়োলেন্স। খবর বলছে, গত এক বছরে মব ভায়োলেন্সে নিহত হয়েছেন ১১৯ জন। মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল, তাই আগুন দিয়েছে, বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে, লুটতরাজও ঘটিয়েছে। কিন্তু মব তো মুভমেন্টের অংশ নয়; মুভমেন্টের বিচ্যুতি বইকি। রাজধানীতে ঘটা একটা ঘটনাই অন্য বহু ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করছে। কিছুদিন আগে ঘটা একটি ঘটনার কথা বলছি। সেটা হলো গুলশান এলাকায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পরলোকগত সাবেক এক উপদেষ্টার পুত্রের সাবেক স্ত্রীর বাসগৃহে আক্রমণ। গুজব রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ওই আবাসে ২০০-৩০০ কোটি টাকা লুকানো আছে। সেই সঙ্গে স্বৈরাচারের দোসরদের কয়েকজনও লুকিয়ে রয়েছে। এতে মবের সংগঠিত হতে কোনো অসুবিধা ঘটেনি। প্রচুরসংখ্যক লোক প্রথমে বাড়ির দেয়াল টপকে, পরে ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতরের সবকিছু তছনছ করেছে। লুকিয়ে থাকা কাউকে পাওয়া যায়নি, টাকাপয়সাও নাকি তেমন ছিল না; তবে মূল্যবান সামগ্রী নিশ্চয়ই বেশ কিছু ছিল। সেগুলো বীরত্বপূর্ণভাবে হস্তগত করতে ঘটনায় অংশগ্রহণকারীরা বিলম্ব করেনি। ওই সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবশ্য কোনো স্মার্টনেস দেখা যায়নি। পরে জানা গেছে মবকে উত্তেজিত করেছিলেন ওই বাড়িরই একজন সাবেক কেয়ারটেকার। বলার অপেক্ষা রাখে না, কেয়ারটেকার মহোদয়ের প্ররোচনা-দানটা রাজনৈতিক আদর্শপ্রণোদিত ছিল না; ছিল লুটপাটের উদ্দেশ্যপ্রসূত। এর কাজটা ব্যতিক্রমধর্মীও ছিল না; মব ভায়োলেন্সের সামনে না হলেও ভেতরে ও পেছনে লুণ্ঠনের অভিপ্রায়টি লুকায়িত অবস্থায় থাকে এবং লুটপাট করাটাকেও অভিযুক্তদের শাস্তিদানের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়। উনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় তখনকার পূর্ববঙ্গে বহু জায়গায় গণ-আদালত বসেছে; কিন্তু সেখানে একধরনের শৃঙ্খলা ছিল এবং অভিযুক্তরা অপরাধী হিসেবে সামাজিকভাবে চিহ্নিত ছিল। মব ভায়োলেন্সে সেসব ব্যাপার নেই। লুটপাটের বাইরে এবং ভেতরে হিংস্রতা এবং সক্ষমতা প্রদর্শনের ব্যাপারটাও থাকে। এবার যেমনটা ঘটেছে। চোর সন্দেহে কাউকে ধরে প্রথমে হাত-পা ভাঙা হয়, এমনকি চোখ উপড়ে ফেলারও খবর পাওয়া গেছে। এ ধরনের ভায়োলেন্সে রাজনীতি থাকে না, তবে ক্রোধ থাকে।


পুলিশকে কে না ভয় করে? বিগত দিনগুলোতে রাষ্ট্রকে বলা হতো পুলিশি রাষ্ট্র। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরে পুলিশকে বিব্রত ও হতোদ্যম মনে হচ্ছিল। এখন তো মনে হয় তারা পুরোনো স্মার্টনেস ফিরে পেতে শুরু করেছে। সম্প্রতি সংবাদপত্রে স্বল্পমাত্রায় হলেও ওই স্মার্টনেসের খবর দেখা গেছে। নারী নির্যাতন বৃদ্ধির প্রতিবাদমুখর একটি মিছিল যাচ্ছিল প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে। পুলিশ বাধা দিয়েছে। বাধা দেবারই তো কথা। কিন্তু এরপরে যা করেছে গণ-অভ্যুত্থানের পরে তা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। সাদাপোশাক পরিহিত পুলিশ মিছিলকারীদের বেধড়ক প্রহার করেছে। কয়েকটি দৈনিকে ছাপা ছবিতে দেখা গেল উগ্রমূর্তি এক পুলিশ একটি মেয়ের চুল ধরে টানছে। এই রকম হৃদয়বিদারক ছবি আমরা আগেও দেখেছি। বিগত সরকারের শাসনামলে ১৫-১৬ বছরে অবশ্য রাজপথে নারীদের ওপর পুলিশের এ রকম আক্রমণ ঘন ঘন দেখা যায়নি, তার কারণ একটাই—মানুষ, বিশেষ করে মেয়েরা, পথে নামতেই সাহস করত না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নেমেছিল গত চব্বিশের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে। ছেলেরা নেমেছিল, মেয়েরাও নেমেছিল। মেয়েদের প্রতিবাদটাই ছিল বিশেষরূপে কার্যকর। মেয়েরা প্রাণও দিয়েছে। মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় ১১ জন প্রাণদানকারীর তালিকা এবং তাদের কাহিনি প্রকাশ করেছে। এদের বাইরেও কেউ কেউ অজানাই রয়ে গেছে, এমনও সম্ভব। ওই আন্দোলনের সূত্রপাতের কালেও অবশ্য মেয়েরা পথে নেমেছিল, তবে শেষের দিকে যেভাবে এসেছে, সেভাবে নয়। এবং প্রথম দিকে পুলিশের পাশাপাশি ছাত্রলীগের ছেলেদেরই দেখা গেছে মেয়েদের হেনস্তা করতে। এখন ছাত্রলীগ নেই, তাই বোধ হয় পুলিশের লোকজনেরই দেখা গেল ছাত্রলীগের ভূমিকা পালন করতে। শেখ হাসিনার রাজত্বকালে ছাত্রলীগের ছেলেদের পুলিশ বাহিনীতে ভর্তি করার একটা নীরব উৎসবই চলছিল; জানি না ইতিমধ্যে যারা স্মার্টনেস প্রদর্শন শুরু করেছে, তারা ছাত্রলীগের ক্যাডার কি না! তবে আশা করব পুলিশ বাহিনী তাদের ওপর রাষ্ট্রীয়ভাবে অর্পিত কর্তব্যে প্রত্যাবর্তন করবে এবং অপরাধ দমনের ব্যাপারে তাদের দক্ষতা প্রদর্শনে ব্রতী হবে। অপরাধ যেহেতু কমছে না, বাড়ছেই; তাদের জন্য তাই বীরত্বের অনুশীলনের ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রের কোনো অভাব ঘটবে না।


দেশে হিংস্রতার ঘটনার যেমন, তেমনি আত্মহত্যার সংখ্যাও বাড়ছে। মানুষ এমনি এমনি আত্মহত্যা করে না; করতে বাধ্য হয়, প্রধানত নিঃসঙ্গতা ও হতাশা থেকে। জীবনের বোঝা বহন থেকে অব্যাহতির একমাত্র পথ যখন মনে হয় জীবনকে শেষ করে দেওয়া, তখনই মানুষ ওই পথ ধরে। সরকারি জরিপ বলছে, ২০২২-২৩ সময়কালে দেশে গড়ে প্রতিদিন ৫৬ জন মানুষ আত্মহত্যা করেছে। ওই জরিপই জানাচ্ছে যে সড়ক দুর্ঘটনার পরেই সর্বাধিক সংখ্যক মৃত্যু ঘটেছে আত্মহত্যায়। মৃত্যু তরুণদের মধ্যে এবং গ্রামে বেশি। গ্রামে আত্মহত্যার আধিক্যের কারণ কর্মসংস্থানের অভাব। গাজীপুরের শ্রীপুর এলাকায় ‘স্ত্রীকে ফোনে রেখে “বিদায়” বলে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ যুবকের।’ তবে আত্মহত্যা শহরেও কম নয়। এবং বয়স্করাও নিজেদের হত্যা করেন বইকি। একজন সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেলের মৃতদেহ পাওয়া গেছে রাজধানীতে তাঁর নিজের বাসায়, কলাবাগানে। তাঁর স্ত্রী একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করেন; ঘটনার সময় তিনি বাসায় ছিলেন না। অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল সম্প্রতি চাকরি হারিয়েছেন; কাজের খোঁজে রোজই তিনি আদালতপাড়ায় যেতেন, কিন্তু সম্মানজনক কাজ পেতেন না। হতাশা থেকে প্রাণহানি ঘটিয়েছেন। একই দিনে চকবাজারে একাকী থাকত এক তরুণী, কাজ করত বিউটি পারলারে বিউটিশিয়ান হিসেবে; সেও ফাঁসি দিয়েছে, নিজেই নিজেকে। আত্মহত্যার সংখ্যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কম নয়, তবে সবচেয়ে বেশি ঘটে নাকি বাংলাদেশেই। আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ বলছে, বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই হতাশায় ভোগেন।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও