আপনি ধনী না গরিব, তা শুধু আপনার সম্পদের ওপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে আপনার কাছাকাছি যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষের সম্পদ কেমন তার ওপর। আপনি হয়তো মাসিক ৫০ হাজার টাকা বেতনে পরমভাবে খুশি থাকবেন। কিন্তু যখনি আপনি দেখবেন, আপনার বন্ধু কিংবা পরিচিতজন আপনার চেয়ে কম যোগ্যতা নিয়ে আপনার থেকে বেশি টাকা বেতন পাচ্ছে, তখন আপনার মাথায় তুলনামূলক চিন্তা ঢুকে যাবে এবং আপনি নিজেকে গরিব ভাবতে শুরু করবেন, এমনকি আপনার চাকরির প্রতিও একধরনের বিরক্তি জন্ম নেবে।
ধরুন, আপনি বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে পড়াশোনা করে সর্বোচ্চ সিজিপিএ নিয়ে পরবর্তী সময়ে ওখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন। এই যে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করলেন, আপনার জন্য প্রণোদনা কী? আপনি চাকরিতে কেমন আছেন বা আপনার চাকরির সুযোগ-সুবিধা কেমন, তা জানবেন কীভাবে? প্রথম উপায় হলো আপনার ক্লাসমেটদের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করা। যারা আপনার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় না পেরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা বিসিএস দিয়ে বিভিন্ন ক্যাডারে যোগদান করেছে, তাদের সঙ্গেই আপনি প্রথমে আপনাকে তুলনা করবেন।
চাকরির শুরুতেই এ চিন্তা না এলেও কয়েক বছর পরে আসতে বাধ্য এবং আপনি এ তুলনা করতে গিয়ে প্রথমে বড় একটা ধাক্কা খাবেন। যখন দেখবেন, সরকারি কলেজের শিক্ষকও আপনার সমান বেতন পায়, তখন আপনার মন খারাপ না হয়ে পারবে না। আপনি যখন দেখবেন, যে চাকরিতে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা প্রথম শ্রেণি (যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা) তার সুযোগ-সুবিধা ওই চাকরির (যেমন বিসিএস) থেকে কম, যেখানে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা দ্বিতীয় শ্রেণি।
আবার এই বিসিএস চাকরিতে এক বছর আগেও ৫৬ শতাংশ কোটা থেকে আসত, যাদের যোগ্যতা ছিল নিম্নমানের। কিন্তু তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের, যাঁরা বেশির ভাগ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন, চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। এ অবস্থায় আপনি কোন বিবেচনায় নির্বিকার থাকবেন? ক্লাসে প্রথম হওয়ার গৌরব নিজের কাছেই আস্তে আস্তে ম্লান হয়ে যাবে।
আপনার মন খারাপের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে চাকরির কয়েক বছর পর। কারণ, এ সময়ের মধ্যে আপনার বিসিএস বন্ধুদের আর্থিক অবস্থা আপনাকে ছাপিয়ে যাবে। দেখবেন, তাদের অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছে সরকারি বড় বড় গাড়িতে চড়ে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে আবার ব্যক্তিগত গাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিক হয়ে যাবে। আপনি ভালো করেই জানেন, তাদের এত টাকাপয়সা কোথা থেকে এসেছে। কিন্তু বেশি কিছু বলতে পারবেন না। তাহলে সমাজ ভাববে, আপনি তাদের প্রতি ঈর্ষান্বিত। আপনি তো শিক্ষক, আপনার অত টাকাপয়সা দরকার নেই। শুধু সালাম পেলেই চলবে। ঈর্ষান্বিত হওয়া তো যাবেই না।
আরও মন খারাপ হবে যখন দেখবেন, এ রকম একজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে আপনার আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশী অপছন্দের পরিবর্তে সমীহ করছে। কোনো অনুষ্ঠানে গেলে দেখবেন, অনেকেই তার জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে। তার অনুপস্থিতি কেমন যেন সবাই অনুভব করছে। দেখবেন, এ রকম দুর্নীতিবাজ লোকের কাছ থেকে অনেকেই নানা রকম সুবিধা নিচ্ছে। বিভিন্ন উৎসবে তার কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য পেয়ে দারুণ খুশি হচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের মধ্যে যারা এখন পড়াশোনা করছে, তারা তাকেই আইকন হিসেবে দেখছে এবং ভবিষ্যতে তার মতো হওয়ার স্বপ্ন বুনছে।
একটা সময় ছিল যখন সরকারি চাকরিজীবীরা দুর্নীতি করলেও চাকরিকালে তার প্রকাশ খুব বেশি দেখা যেত না। আবার এত বেশিসংখ্যক দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাও ছিল না। গত দেড় দশকে সরকার আমলাদের সুবিধা অযৌক্তিকভাবে বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে যে রকম অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তা সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। কোনো কোনো ক্যাডারে দুর্নীতি না করা কর্মকর্তার সংখ্যা প্রায় হাতে গোনা। এসব ক্যাডারে চাকরির ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে কর্মকর্তারা অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে যায়। এসব অসৎ কর্মকর্তাদের সম্পদের পাহাড় সৎ কর্মকর্তাদের ওপরে একধরনের চাপ তৈরি করে। একই সমাজে বসবাসের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জীবনেও এর প্রভাব এসে পড়ছে।
তুলনীয় চাকরির সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি করে, এমন উৎসগুলো যথাসম্ভব কমিয়ে নিয়ে আসতে হবে। যেমন একজন ডিসির যেহেতু জেলার বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়, তাই তার জন্য একটা বড় গাড়ির দরকার হতে পারে। কিন্তু কোন বিবেচনায় অসহনীয় যানজটের এ ঢাকা শহরে আজিমপুর থেকে সচিবালয়ে যেতে একজন কর্মকর্তার জন্য ঢাউস সাইজের একটা গাড়ি বরাদ্দ করতে হবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটের ২০ থেকে ২৫ জন শিক্ষক যদি একটা মিনিবাসে করে উত্তরা থেকে তাঁদের নিজ নিজ ক্যাম্পাসে আসতে পারেন, তাহলে আমলাদের একই রকম বাসে করে অফিসে যেতে সমস্যা কোথায়? আবার ঢাকা মেডিকেলের একজন ডাক্তারকে যদি সাত দিন আগে রিকুইজিশন দিয়ে একটা গাড়ি পেতে হয়, আর সে রকম যোগ্যতার একই ডাক্তার যখন কোনো বাহিনীতে চাকরি করে দেখেন, তাঁর জন্য দুটি গাড়ি বরাদ্দ থাকে, তাহলে ঢাকা মেডিকেল তাঁর কাছ থেকে ভালো সেবা পাবে না। গাড়িকে মর্যাদার প্রতীক হিসেবে না দেখে প্রয়োজন হিসেবে বিবেচনা করলে বেতন–বৈষম্যের উৎসও কমে যাবে। বড় গাড়ি মানে বেশি মর্যাদা, বেশি ক্ষমতা—এ নিচুতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।