
অবৈধ কৃষি-শ্রমিকদের গণবহিষ্কারে বিপদে ট্রাম্প
শিল্পবিপ্লব-পূর্ব যুক্তরাষ্ট্র ছিল মূলত কৃষিনির্ভর। খামার মালিকদের কৃষি-শ্রমিকের চাহিদা পূরণে দাস ব্যবসায়ীরা ১৭শ’ শতকের শুরু থেকে পরবর্তী দু’শ বছর পর্যন্ত আফ্রিকান দেশগুলো থেকে দাস আমদানি করেছে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রে দাস ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হলেও কৃষি-শ্রমিকের চাহিদা যেহেতু শেষ হয়ে যায়নি, তাই গোপনে দাস আমদানি অব্যাহত ছিল এবং মেক্সিকো ও সেন্ট্রাল আমেরিকান দরিদ্র দেশগুলো থেকেও প্রচুর কৃষি-শ্রমিক অবাধে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে কৃষি মৌসুম শেষে দেশে ফিরে যেত। অনেকে রয়েও যেত।
শিল্প বিপ্লবোত্তর সময়ে কারখানা শ্রমিকদেরও চাহিদা ছিল। হাইটেক যুগে শ্রমঘন শিল্পের অবসান ঘটলেও ক্ষুদ্র শিল্প ও বিপণন শিল্প আবার শ্রমঘন হয়ে উঠেছে; তা সত্ত্বেও কৃষি-শ্রমিকের চাহিদা আগের মতোই রয়েছে। এখনো যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ লাখ বর্গমাইল এলাকায়, অর্থাৎ বাংলাদেশের মোট আয়তনের ২৫ গুণ বেশি জমিতে খাদ্যশস্য, সবজি ও ফলের চাষ হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ব্যাপকভাবে যন্ত্রনির্ভর হলেও ফসল তোলার জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব লেবারের ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যা ২৬ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ১০ লাখই অবৈধ অভিবাসী, যা মোট কৃষি-শ্রমিকের প্রায় ৪৫ শতাংশ। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের ঢালাও গ্রেফতার ও গণবহিষ্কার করতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়েছেন। খামার মালিক এবং কৃষিবিষয়ক সংগঠনগুলো ট্রাম্পের কৃষি-শ্রমিকদের গণবহিষ্কার পরিকল্পনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। কারণ এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে ফসল উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ব্যাপকভাবে অভিবাসী শ্রমিকের ওপর নির্ভরশীল এবং কেবল আমেরিকান ও বৈধ অভিবাসীদের দ্বারা তাদের স্থলাভিষিক্ত করা অসম্ভব ব্যাপার। কৃষি-শিল্প গ্রুপগুলোও ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটিকে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে কৃষি-শ্রমিকদের বিপুল অংশ অবৈধ অভিবাসী হলেও কৃষি অর্থনীতিকে সচল রাখার স্বার্থে তাদের গণবহিষ্কারের আওতামুক্ত রাখার আহ্বান জানিয়েছে।
কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্তে অনড়। কর্মস্থলে হানা দিয়ে অবৈধ অভিবাসীদের গ্রেফতার অভিযান তুলনামূলকভাবে সহজ। কারণ তারা শহর ও লোকালয়ের বাইরে উন্মুক্ত জায়গায় কাজ করে এবং পালিযে যেতে পারে না। অতএব, শ্রমজীবী অবৈধ অভিবাসীদের মধ্যে যারা ইতোমধ্যে গ্রেফতার ও বহিষ্কৃত হয়েছে, তাদের মধ্যে একক গ্রুপ হিসাবে কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। খামার মালিক ও কৃষি-শিল্প গ্রুপগুলোর অনুরোধে ট্রাম্প কৃষি খামার ও কৃষি-শিল্পকে তার অভিবাসীবিরোধী অভিযানের আওতাবহির্ভূত রাখবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি। যেখানেই অবৈধ অভিবাসী, সেখানেই অভিযান চলবে। ক্যালিফোর্নিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপ্রধান অঙ্গরাজ্য, যেখানে বিভিন্ন ধরনের ৩৫০টির বেশি খাদ্যশস্য, সবজি, ফল ও বাদাম উৎপাদিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মোট চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ সবজি, দুই-তৃতীয়াংশ ফল ও বাদাম এবং স্ট্রবেরির ৯০ শতাংশই উৎপাদিত হয় ক্যালিফোর্নিয়ায়। যুক্তরাষ্ট্রে কর্মরত মোট ২৬ লাখ কৃষি-শ্রমিকের প্রায় আট লাখই বাস করে ক্যালিফোর্নিয়ায়, যাদের প্রায় অর্ধেক অবৈধ অভিবাসী। এ বিপুলসংখ্যক অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করা হলে ক্যালিফোর্নিয়ার কৃষি মুখ থুবড়ে পড়বে। গ্রোসারিগুলোতে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ হ্রাস পাবে এবং অকল্পনীয় হারে মূল্য বৃদ্ধি পাবে। বাজারে ইতোমধ্যেই সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভোক্তারা দুর্ভোগের মুখোমুখি হচ্ছেন।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য এককভাবে যদি কোনো খাতকে দায়ী করতে হয়, তাহলে সেটি কৃষি খাত। তিনি মনে করেন, কৃষিতে সাময়িক সময়ের জন্য শ্রমিক সংকট দেখা দিলেও শিগগিরই তা পূরণ হবে আমেরিকান ও বৈধ অভিবাসী শ্রমিক দ্বারা। তার মতে, কৃষি খামারের মালিকরা যত অজুহাতই দেওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, তারা তা করছেন স্বল্প মজুরিতে অবৈধ অভিবাসীদের শ্রম আদায়ের জন্য। তারা অবৈধ অভিবাসী শ্রমিকদের শ্রম শোষণ করে দশকের পর দশক ধরে মুনাফা লুটছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে কাজ করার অনুমতি রয়েছে এমন শ্রমিকদের কৃষিতে নিয়োগ করা হলে তাদের নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরি দিতে হবে। এতে খামার মালিকদের মুনাফা অর্জনের হার কমলেও কৃষি-শ্রমিকরা লাভবান হবে।
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে (২০১৭-২০২০) তার প্রশাসন প্রতিবছর গড়ে ২ লাখ ৭৬ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে বহিষ্কার করেছে। কিন্তু কৃষি খামার ও কৃষিজাত পণ্যের শিল্প টিকিয়ে রাখার স্বার্থে গত বছর (২০২৪) প্রায় ২ লাখ ৫৮ হাজার চুক্তিভিত্তিক কৃষি-শ্রমিককে ‘এইচ ২-এ’ ভিসা বা বিদেশি কৃষি-শ্রমিকদের সাময়িকভাবে, অর্থাৎ ফসল তোলার মৌসুমে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের চুক্তিভিত্তিক কৃষি-শ্রমিকের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট কৃষি-শ্রমিকের এক-দশমাংশ, যে সংখ্যা গত ছয় বছরে এক লাখের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ অভিবাসীদের বহিষ্কারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে চুক্তিভিত্তিক কৃষি-শ্রমিক নিয়ে আসা কোনো নতুন বিষয় নয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে চুক্তির অধীনে মেক্সিকো থেকে কৃষি ও রেলওয়ে শ্রমিক হিসাবে নিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ শ্রমিককে বহিষ্কার করেছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পরিবর্তে চুক্তিভিত্তিক ৩ লাখ ১০ হাজার শ্রমিক এনেছিল। দুই বছর পর এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পায় এবং যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকো থেকে চুক্তিভিত্তিক ৪ লাখ ৪৫ হাজার কৃষি-শ্রমিক আসার অনুমতি দেয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কৃষিকাজ
- শিল্প বিপ্লব
- ডোনাল্ড ট্রাম্প