রাজস্ব আহরণে নবদিগন্ত

দেশ রূপান্তর মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রকাশিত: ২২ আগস্ট ২০২৫, ১৩:৩২

মূলত এবং মুখ্যত নব্বইয়ের দশকেই, বাংলাদেশে রাজস্ব আহরণে ঊর্ধ্বমুখী অগ্রযাত্রা শুরু। ১৯৯১-এর শুরুতে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসে। বাংলাদেশে ট্রেডিং নির্ভরতা থেকে উৎপাদনমুখী অর্থনীতির নবযাত্রা শুরু হয় তখন থেকেই। প্রথম বছরেই মূল্য সংযোজন কর আইন পাস ও প্রবর্তিত হয়। বিরানব্বই সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লোকবল ও কর্মকাঠামোয় প্রথম সম্প্রসারণ ও সংস্কার আনা হয়। সে সময় বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় নতুন উদ্যম ও নতুন উদ্যোগ সংযোজিত হওয়ায় অর্থনৈতিক খাতের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এই দশকেই তিনবার (১৯৯২, ১৯৯৬ ও ১৯৯৯) ঘোষিত হয় সংশোধিত শিল্পনীতি। ১৯৯৩ সালে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন গঠন, প্রাইভেটাইজেশন বোর্ড প্রতিষ্ঠা, সাউথ এশিয়ান প্রিফারেনসিয়াল ট্রেড অ্যারেঞ্জমেন্ট (সাফটা) চুক্তি স্বাক্ষরিত এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন অ্যাক্ট পাস হয়। ১৯৯৪ সালে প্রথম সেলুলার ফোন পদ্ধতি চালু, ১৯১৩ সালের কোম্পানি আইন প্রথম সংশোধন, টাকাকে চলতি হিসাবে লেনদেনের জন্য রুপান্তরযোগ্য ঘোষণা, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের ৮নং আর্টিকেলের মর্যাদা লাভ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো আইন ও বিধিমালা জারি হয়। ১৯৯৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ (আইসিসিবি) গঠিত হয় এবং চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ চালু হয়। ১৯৯৬ সালে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ে পাওয়ার সেল গঠন, গ্রাসাধার বিধিমালা জারি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা প্রতিষ্ঠা, প্রাইভেট এক্সপার্ট প্রসেসিং জোন আইন পাস এবং প্রাইভেট পাওয়ার জেনারেশন পলিসি ঘোষণা করা হয়।


দশকের প্রথমার্ধে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, উৎপাদন তথা আর্থিক খাতে যুগোপযোগী আইন প্রবর্তন, নীতি-নিয়ম পদ্ধতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার সাধিত হওয়ার ফলে রাজস্ব আহরণের উপায় উন্নতি দৃশ্যগ্রাহ্য হয়। ‘মূসক’ আইন প্রবর্তনসহ বেশ কয়েকটি রেগুলটরি সংস্থা প্রতিষ্ঠার ফলে, কর রাজস্ব আহরণের প্রকৃতি বিস্তৃত হয় ও সার্বিক রাজস্ব আহরণের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ১৯৮৭-৮৮ সালে জিডিপি ৫৯৭ বিলিয়ন থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১২৫৪ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ২০০২ বিলিয়ন টাকায় উন্নীত হয় এ দশকেই। ভোগ জিডিপির রেশিও ১৯৮৭-৮৮ সালে সেখানে ছিল ৯৭%, ১৯৯২-৯৩ সালে তা ৮৭.৭% এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ৮২.৬%-এ নেমে আসে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, জাতীয় সঞ্চয় ও জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালে ১০.৭ থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১৮.০ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ২১.৮-এ উন্নীত হয় এবং মোট বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালে ১১.৮ থেকে ১৯৯২-৯৩ সালে ১৭.৯ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ২১.৬-এ উন্নীত হয়। এর প্রভাব প্রতিফলন ঘটে, রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতিতে-১৯৮৭-৮৮ সালে। এনবিআর অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ যেখানে ছিল ৩৯.৫ বিলিয়ন টাকা, ১৯৯২-৯৩ সালে তা ৮৬.৪ এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ১৩৮ বিলিয়ন টাকায় বৃদ্ধি পায়। কর রাজস্ব আয় ও জিডিপির অনুপাত ১৯৮৭-৮৮ সালে ৮.৭% থেকে ১৯৯২-৯৮ সালে ৮.৮% এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে তা ৯.৪%-এ উন্নীত হয়। এরপর অবশ্য কর জিডিপি ও রেশিও আর তেমন বাড়েনি। মূলত কাছাকাছি থাকে। এর অর্থ হলো, অর্থনীতিতে আয়-ব্যয় বৃদ্ধি পেলেও কর রাজস্ব আয় সমানুপাতিক হারে বাড়েনি।


নব্বইয়ের দশক থেকেই বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৮৭-৮৮ সালে আমদানির পরিমাণ ছিল ২৯৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১৯৯২-৯৩ সালে তা ৩৯৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে ৭৫৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছায়। অপরদিকে, যে রপ্তানি ১৯৯৭-৯৮ সালে ১২৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ১৯৯২-৯৩ সালে তা প্রায় দ্বিগুণ ২৩৮৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে রেকর্ড ৫১৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়ায়। আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যের অতি প্রাগ্রসরমান এ তথ্য-উপাত্ত পরিসংখ্যান নির্দেশ করে, একটি দ্রুত গতিশীল অর্থনীতির এবং সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় আমদানি শুল্ক, আয়কর এবং মূল্য সংযোজন কর আহরণের ক্ষেত্র বিস্তৃতির অবকাশ। কিন্তু প্রণিধানযোগ্য যে, এ দশকে আমদানি-রপ্তানি শুল্ক ও মূশক তথা কাস্টমস বিভাগে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পেলেও, আয়কর বিভাগের আয়ে অগ্রগতি সমানুপাতে আসেনি। ১৯৯১ সালে মূল্য সংযোজন কর আইন পাস এবং প্রবর্তন বাংলাদেশের রাজস্ব আহরণ ইতিহাসে একটি নতুন মাইলফলক। অবশ্যই এটি ইতিবাচক এবং দূরদর্শী পদক্ষেপ। বাংলাদেশে ভ্যাট আইন প্রবর্তনের প্রাক্কালে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশে যে আন্দোলন আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, বাংলাদেশে অনুরূপ অন্য কোনো আইন প্রবর্তনের সময় এত সমালোচনা ও বিরোধিতা অতীতে হয়নি। বিরোধিতার প্রবল আন্দোলনের মুখেও মূসক আইনটি পাস ও প্রবর্তনে দৃঢ়তা প্রদর্শন এবং দূরদর্শিতার পরিচয় দেয় সমকালীন সরকার। প্রকৃত প্রস্তাবে আবহমান কাল থেকে চলে আসা ১৯৩০ সালের সেল অব গুডস অ্যাক্ট বা বিক্রয় কর ব্যবস্থাপনা এবং ১৯৬৯ সালের কাস্টমস অ্যাক্টের সংশ্লিষ্ট ও প্রযোজ্য কিছু ধারা-উপধারার প্রতিস্থাপন হিসেবে মূল্য সংযোজন কর (অধুনা বিশ্বে অনেক দেশে যা জিএসটি হিসেবেও চালু আছে) প্রবর্তনের অনিবার্যতা অনস্বীকার্য হয়ে উঠেছিল। যদিও এ আইনের প্রতি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিবেশ ইতিবাচকভাবে সাড়া দিতে প্রস্তত ছিল না। যথারীতি বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের পরামর্শ ও দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ ও গবেষণা টিমের মাধ্যমে পরিচালিত সমীক্ষার মাধ্যমে, ভ্যাট আইন প্রণয়নের উদ্যোগ থাকলেও- বাংলাদেশের অর্থনীতি তৎকালীন প্রেক্ষাপট পুরোপুরি ছিল অন্যরকম অধ্যায়ে। ফলে ভ্যাট আইন অনুধাবন এবং স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা-পর্যলোচনার সুযোগ হয়তো তেমনভাবে নেওয়া হয়নি বা নেওয়া যায়নি এবং একই সমতলে অর্থনৈতিক অগ্রগতি দ্রুত বেগবান হওয়ার সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতি ধারণ ও ব্যাখ্যার সুযোগ নতুন আইনে ততটা ছিল না। দেশের অর্থনীতি তখন সবে ট্রেডিং ও আমদানি নির্ভরতা থেকে উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী হওয়ার পথে, বাজার অর্থনীতিতে কর্মচাঞ্চল্য বেশ বেগবান, ভোগ ও সঞ্চয় পরিস্থিতিতে আসা পরিবর্তন, সব মিলিয়ে এ প্রেক্ষাপটে মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তনটি ছিল যুগান্তকারী ঘটনা। ভ্যাট আইন প্রবর্তিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বিক্রয় কর থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের পরিমাণ ছিল সামান্য। ১৯৮৭-৮৮ সালে বিক্রয় কর বাবদ রাজস্ব আয় ছিল ৫৪৩ কোটি টাকা, সে তুলনায় ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে অর্থাৎ ভ্যাট আইন প্রবর্তনের পরের বছরই ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাবদ রাজস্ব আয় হয়, ১৭৬৩ কোটি এবং ১৯৯৭-৯৮ সালে সে আয় ৩৪৬৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। প্রসঙ্গত, তখন পর্যন্ত শুধু আমদানি শুল্কই ছিল রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তনের ফলে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদন ও বিপণন এবং আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষেত্রে সম্পূরকসহ শুল্ক হিসাবায়ন ও আদায় অভিযাত্রায় একটি গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয় এবং উঠে আসে ভোক্তা কর্তৃক প্রদত্ত পরোক্ষ (পণ্য ও সেবা) কর হিসাব ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা বৃদ্ধির তাগিদ। তবে প্রথম দিকে এ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হতে এবং করদাতা ও আহরণকারী উভয় পক্ষের মধ্যে নানান অনুযোগ অজুহাতে এক ধরনের ‘সময় নেওয়ার’ প্রবণতা লক্ষ করা যায়। অর্থনীতি যখন সবে বড় হওয়া শুরু, সে সময় নতুন ভ্যাট আইন হঠাৎ করে কিছুটা হলেও গোলকধাঁধার পরিবেশ সৃষ্টির দ্যোতক হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে এর গ্রহণ ও প্রয়োগ যোগ্যতায় আনা হয় সংস্কার। ২০১২ সালে (কথিত) নতুন ভ্যাট আইনটি পার্লামেন্টে নতুন মোড়কে পাস করা হলেও, ১৯৯১ সালের মতো ব্যবসায়ীদের অব্যাহত অনুযোগ অজুহাত এবং যা মোকবিলায় পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণের দীর্ঘসূত্রিতায়, সর্বোপরি এ আইন বাস্তবায়নে দৃঢ়সংকল্প রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপ্রতুলতায় এটি প্রবর্তিত হতে পারেনি বিগত ৭ বছরেও। তথাপিও ভ্যাট আইন প্রবর্তন ও বাস্তবায়নে বাংলাদেশ এখনো প্রতিবেশী বৃহৎ ভারতীয় অর্থনীতির চেয়ে পারঙ্গমতার সঙ্গে অগ্রগামিতায়।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও