পরীক্ষার ফলেই মনোযোগ, শিশু-কিশোরদের জগৎ ছোট হয়ে গেছে
প্রায় দুই দশক পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) আবার শুরু হতে যাচ্ছে ‘নতুন কুঁড়ি’। সর্বশেষ যাঁরা নতুন কুঁড়িতে অংশ নিয়েছেন কিংবা অনুষ্ঠানটি নিয়মিত দেখতেন, তাঁরা খবরটি শুনে স্বাভাবিকভাবেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন। এখন তাঁদের অনেকেরই সন্তান এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। কিন্তু প্রশ্ন, এত দিন কেন জনপ্রিয় আয়োজনটি বন্ধ ছিল।
১৯৬৬ সালে পাকিস্তান টেলিভিশনে প্রথম প্রচারিত হয় নতুন কুঁড়ি। বাংলাদেশ টেলিভিশন ১৯৭৬ সালে নতুন করে অনুষ্ঠানটি শুরু করে। শোনা যায়, স্বাধীনতার পর বিশেষ একটি সরকারের আমলে এটি শুরু হওয়ার কারণে আওয়ামী লীগ সরকার এটিকে আর এগিয়ে নেয়নি। এ রকম একটি আয়োজনকে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণে বিচার করার ফলে গত ২০ বছরে হাজার হাজার শিশু-কিশোর বঞ্চিত হয়েছে।
মুশকিল হলো, এখন অভিভাবকেরাও পড়াশোনা আর ফলাফল ছাড়া সন্তানের কাছ থেকে আর কিছু আশা করেন না। তাই এ যুগের ছেলেমেয়েদের গন্তব্য হয়েছে বাসা থেকে স্কুল আর কোচিং পর্যন্ত। খুব ব্যতিক্রমী কিছু উদাহরণ বাদ দিলে অভিভাবকেরা সন্তানকে সারাক্ষণ পড়ার টেবিলেই দেখতে চান।
শিশু-কিশোরদের জগৎও সংকুচিত হয়ে আছে। তাদের জন্য সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ রয়েছে, এমন প্রতিষ্ঠানও সীমিত। যতটুকু আছে শহর পর্যায়ে; উপজেলা বা গ্রাম পর্যায়ে এমন কেন্দ্র নেই বললেই চলে। তা ছাড়া শহরের ছেলেমেয়েদের বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করার মাঠও নেই। ফলে তাদের সময় কাটানোর একমাত্র উপায় হয়ে উঠেছে মোবাইল বা কম্পিউটার।
দুঃখজনক হলো, স্কুলগুলোর সহশিক্ষা কার্যক্রম যথেষ্ট সন্তোষজনক নয়। কোনো কোনো স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণের অনুষ্ঠান হয়। তবে প্রায় প্রতিটি স্কুলই শিক্ষার্থীদের নিয়মিত খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ করে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ সরকারি নির্দেশনাতেই আছে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে পড়ে খেলাধুলা ও শরীরচর্চা, সংস্কৃতি ও সৃজনশীল কার্যক্রম, বিজ্ঞান ক্লাব ও প্রকল্পভিত্তিক কাজ, বিতর্ক ও জনসমক্ষে বক্তৃতা, সামাজিক সেবা ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম।
এসব কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন ঘটে, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়, একাডেমিক দক্ষতা বাড়ে, সামাজিক যোগাযোগের ভিত্তি তৈরি হয়। বিভিন্ন দেশের শিশুরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আয়োজন ও বিনিময়ের মাধ্যমে পরস্পর মিলনের সুযোগ পায়। এর উপযোগিতার কথা মনোবিদেরাও বলে থাকেন। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে শিশু-কিশোরেরা এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রধানত এই দায়িত্ব স্কুলগুলোকেই নিতে হবে। সাপ্তাহিক ক্লাস রুটিনে পাঠ্যবিষয়ের বাইরেও কিছু অতিরিক্ত ক্লাস রাখতে হবে। যেমন সপ্তাহে একটি পিরিয়ড থাকবে লাইব্রেরি ক্লাস। এই ক্লাসে ওই শ্রেণির শিক্ষার্থীরা লাইব্রেরিতে বসে তাদের পছন্দের বই পড়বে। থাকবে খেলাধুলার আলাদা ঘণ্টা। এ সময় তারা স্কুলমাঠে খেলার সুযোগ পাবে। থাকবে বিভিন্ন ক্লাব এবং সাংস্কৃতিক চর্চার কেন্দ্র। বিতর্ক ও আলোচনা করা, প্রজেক্ট তৈরি, সমাজসেবামূলক কাজ—এসবের পাশাপাশি আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন, গান, নাচ, অভিনয় ইত্যাদির সুযোগ রাখতে হবে।
কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশ গুরুত্ব দিয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছে। এটা অবশ্যই সাধুবাদের যোগ্য। কিন্তু ব্যাপারটি যেন কিছু কিছুর মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। এ জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগেই প্রতিটি স্কুল-কলেজে সহশিক্ষা কার্যক্রম নিশ্চিত করতে হবে। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে স্কুল-কলেজগুলো সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি উৎসব করতে পারে। এ উৎসবে অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের আমন্ত্রণ জানানো যায়।
অবশ্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের (মাউশি) উদ্যোগে প্রতিবছর জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ উদ্যাপন করা হয়। সেখানে নানা ধরনের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। কিন্তু শুধু প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে আসল লক্ষ্য অর্জিত হবে না। স্কুল-কলেজ পর্যায়ে তো বটেই, দেশের নানা জায়গায় শিশুদের সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগকে সরকারিভাবেই উৎসাহিত করতে হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- শিশুর বিকাশ
- সংস্কৃতি চর্চা
- নতুন কুঁড়ি