
সিলেটের সাদা পাথরে সংঘাতের সমাজতত্ত্ব ও নীতি-সংকট
প্রাকৃতিক সম্পদকে আমরা সাধারণত উন্নয়নের আশীর্বাদ হিসেবে দেখি। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো নির্মাণ ও জাতীয় গৌরব অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু গ্লোবাল সাউথের বহু দেশের মতো, বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রাকৃতিক সম্পদ প্রায়শই একটি জটিল ও দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করে। সঠিক নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া যখন সম্পদ উত্তোলন করা হয়, তখন তা দুর্নীতি, পরিবেশের ভয়াবহ ধ্বংস এবং স্থানীয় মানুষের জীবন-জীবিকার অবক্ষয় ডেকে আনে। উন্নয়নের চালিকাশক্তি হওয়ার বদলে এ সম্পদগুলো সংঘাতের উৎসে পরিণত হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটের সীমান্ত অঞ্চলে সাদা পাথর চুরির ঘটনা এ সমস্যার তীব্রতা আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। প্রথম দৃষ্টিতে এটি হয়তো স্থানীয় পর্যায়ের একটি অপরাধ মনে হতে পারে, কিন্তু সমাজতাত্ত্বিকভাবে এটি একটি বৃহত্তর কাঠামোগত সমস্যার প্রতিচ্ছবি। এ সমস্যাটি এক্সট্র্যাকটিভিজম বা সম্পদ-শোষণ মডেল নামে পরিচিত।
সমাজতত্ত্বে এক্সট্র্যাকটিভিজম বলতে এমন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে বোঝানো হয়, যেখানে প্রাকৃতিক সম্পদকে বৃহৎ আকারে উত্তোলন করা হয়, যার প্রধান উদ্দেশ্য হলো দ্রুত মুনাফা অর্জন বা রপ্তানি।
এই প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষতির হিসাব প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়। লাতিন আমেরিকার প্রখ্যাত পরিবেশবাদী চিন্তাবিদ এদুয়ার্দো গুদিন্যাস এবং রাজনৈতিক পরিবেশতত্ত্ববিদ মাইকেল ওয়াটস তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এই এক্সট্র্যাকটিভিজম মডেল কীভাবে সমাজের বৈষম্য বৃদ্ধি করে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে দুর্বল করে এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে প্রতিরোধ আন্দোলনকে উসকে দেয়।
বাংলাদেশে হয়তো স্বর্ণ, তামা বা তেলের মতো বিশাল খনি নেই, কিন্তু কাঠামোগত দিক থেকে সিলেটের সাদা পাথর চুরির ঘটনা একই ধরনের সমস্যার প্রতি ইঙ্গিত করে। এখানে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও একটি শক্তিশালী অবৈধ নেটওয়ার্কের যোগসাজশে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এই কার্যক্রমের ফলে অর্জিত বিপুল মুনাফা সীমিত সংখ্যক মানুষের হাতে যাচ্ছে, অন্যদিকে এর ভয়াবহ পরিবেশগত ও সামাজিক ক্ষতির বোঝা বহন করছে স্থানীয় মানুষ এবং প্রকৃতি। এটি মূলত উন্নয়নের একটি অসম মডেল, যা সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশকে ধনী করে তোলে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে আরও দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ঠেলে দেয়।
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, সিলেটের এই সংকটকে শুধু একটি পরিবেশবিরোধী অপরাধ হিসেবে দেখা ভুল হবে। এটি মূলত উন্নয়নের দুটি বিপরীত ধারার মধ্যে একটি গভীর সংঘাত। একদিকে রয়েছে এক্সট্র্যাকটিভিজম, যা প্রাকৃতিক সম্পদকে কেবল অর্থনৈতিক পণ্য হিসেবে দেখে এবং এর বাজারমূল্যের ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয়। এই মডেলের মূল উদ্দেশ্য হলো বাজারের চাহিদা মেটানো এবং সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জন করা। অন্যদিকে আছে পরিবেশ ন্যায়বিচারের ধারণা—যেটি মনে করে প্রাকৃতিক সম্পদের শুধু অর্থনৈতিক মূল্য নেই, এর সাংস্কৃতিক, পরিবেশগত এবং সামাজিক মূল্যও অপরিসীম, যা কোনোভাবেই বাজারের মানদণ্ডে মাপা সম্ভব নয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- পাথর কোয়ারি