
স্ক্রিনে আবদ্ধ শৈশব, স্মার্টফোন নির্ভরতা কি নতুন ব্যাধি?
বিশ্বজুড়ে স্মার্টফোন এখন জীবনের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এর ব্যাপক ব্যবহারের ফলে স্মার্টফোন আসক্তি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হিসেবে দেখা দিচ্ছে। শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক সবাই কম-বেশি এই সমস্যার শিকার। এই প্রযুক্তি স্মার্টফোন, কম্পিউটার, টেলিভিশন, ট্যাবলেট কিংবা গেম কনসোলের প্রতি নিয়মিত ও অতিরিক্ত নির্ভরতা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।
রাজধানীর নামকরা একটি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র রাফি ইসলাম (ছদ্মনাম)। বয়স ১৫ বছর। কিন্তু তার আচরণে যেন একটি নতুন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। একটি প্রজন্ম, যারা বড় হচ্ছে স্মার্টফোনের আলো-আঁধারিতে। রাফির মা শারমিন আক্তার বলছিলেন, “আগে স্কুল থেকে ফিরেই আমার সঙ্গে গল্প করতো আজ কী শিখল, ক্লাসে কী হলো, বন্ধুদের সঙ্গে কী খেলল। এখন বাসায় ফিরে সে যেন আর আমাদের বাড়ির কেউ না। সরাসরি মোবাইল চায়, না পেলে রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দেয়, পড়তে চায় না।”
রাফির এই অভ্যাস আজকের বিষয় নয়। চার বছর ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তার এই মোবাইল নির্ভরতা। মা অথবা বাবার ফোন নিয়ে ইউটিউব দেখা, ভিডিও গেম খেলা, টিকটক বা ফেসবুকের ভিডিও স্ক্রল করে সময় কাটানোই যেন তার নতুন জীবনযাপন। শত নিষেধ-বারণেও থামছে না এই আসক্তি। এমনকি সম্প্রতি সে নিজের একটি স্মার্টফোন চেয়ে চাপ দিচ্ছে মা-বাবাকে। আর তা না পেলে তার ‘সাবধানবাণী’ কিছু খাবে না, পড়ালেখা করবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুরা যখন বয়সের তুলনায় বেশি সময় মোবাইল স্ক্রিনে কাটাতে থাকে, তখন তা তাদের মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশুরা হয়ে পড়ে একাকী, আবেগ নিয়ন্ত্রণে দুর্বল, ঘুমের সমস্যা হয়, এমনকি শারীরিক কার্যকলাপ কমে গিয়ে স্থূলতা দেখা দেয়।
তারা বলেন, “এটি নিছক কোনো খারাপ অভ্যাস নয়। এটি এখন একধরনের ‘ডিজিটাল অ্যাডিকশন’। শিশুরা যদি দৈনিক দুই ঘণ্টার বেশি সময় মোবাইল স্ক্রিনে ব্যয় করে, তাহলে তার শরীর ও মন দুটোর ওপরই ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। অথচ শহরাঞ্চলের অনেক শিশুর ক্ষেত্রেই এই সময়সীমা ৫-৬ ঘণ্টা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”
সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অনলাইনে পড়াশোনার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এর সুযোগ নিতে গিয়ে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে বিনোদনের দিকে। রাফির মতো অনেকই এখন অনলাইনে ক্লাসের নাম করে ইউটিউব বা গেমে ব্যস্ত থাকে।
ঢাকার একটি সরকারি স্কুলের শিক্ষক জানালেন, ‘আমরা অনলাইন ক্লাসের সময় একাধিকবার দেখেছি, শিক্ষার্থীরা পড়ার সময় স্ক্রিনের অন্য ট্যাবে গেম চালু করে রেখেছে। এটা আমাদের জন্যও উদ্বেগজনক।’
বড়দের ক্ষেত্রে এই আসক্তি বিভিন্ন ব্যক্তিগত মানসিক ও পরিবেশগত কারণে তৈরি হতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে উদ্বেগ, একাকীত্ব এবং মানসিক চাপ জমতে জমতে এমন এক অবস্থায় পৌঁছায়, যেখানে তারা বাস্তবতা থেকে পালাতে ফোনকে আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করে।
আবার দীর্ঘদিন ধরে এর ব্যবহার অভ্যাসে পরিণত হলে আসক্তিতে রূপ নেয়। এছাড়াও স্মার্টফোন অ্যাপস ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে অবিরাম সংযোগ ও মুঠোফোন-ভিত্তিক সুবিধা পাওয়া যায়, যা ব্যবহারকারীদের ফোন থেকে দূরে থাকতে দেয় না। এর অভ্যাসগত ব্যবহারের ফলে সামনাসামনি যোগাযোগের সুযোগ কমিয়ে দেয়, মনোযোগ বিচ্যুতি ঘটায়, ঘুমের সময় কমিয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২০২০ সালের শুরুতে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে শিক্ষার্থীদের জীবনধারায় আমূল পরিবর্তন আসে। অনলাইন শিক্ষার প্রসার, বাইরে যাওয়া বন্ধ হওয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, সব মিলিয়ে স্মার্টফোন শিক্ষার্থীদের জীবনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়। এই সময়ে স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার বেড়ে যায়, যা স্মার্টফোন আসক্তির ঝুঁকি অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্মার্টফোন আসক্তি